লেখক: সেলিম জাহিদ ঢাকা।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তোলার পাশাপাশি তাঁর কবর ও মরদেহ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার পেছনে সরকারি দলের তিনটি দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে মনে করে বিএনপি। এগুলোর মধ্যে করোনা টিকা, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকা দেওয়া এবং মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোকে প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
এ ছাড়া এই রাজনৈতিক বিতর্কে আটকে রেখে বিএনপিকে বিভ্রান্ত ও নাজেহাল করা এবং উত্ত্যক্ত করে বিএনপিকে মাঠে নামানোও সরকারের এই প্রচারণার অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর সরানোর লক্ষ্যে পরিবেশ তৈরির চেষ্টার অংশ হিসেবে নতুন করে বিষয়টি সামনে আনা হতে পারে। কারণ, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর সরানোর কথা তুলেছিলেন সরকারি দলের নেতারা।
গত ১৭ আগস্ট চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে বিএনপির কর্মীদের পুলিশ বাধা দিলে সেখানে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করে ২৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরে যে মারামারি করল বিএনপি, তারা জানে না যে ওখানে জিয়ার লাশ নেই? তারা তো ভালোই জানে। তাহলে ওই নাটক করল কেন তারা? খালেদা জিয়াও খুব ভালোভাবে জানে।’ এরপর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রী ও নেতারা এ নিয়ে আরও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য বিএনপিকে চাপের রাখার কৌশল, নাকি জিয়ার কবরসহ সংসদ ভবন এলাকার নকশাবহির্ভূত স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে নানা আলোচনা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই সরকারের একটা দুরভিসন্ধি আছে। আমরা মনে করি, এটি হচ্ছে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, নিজেদের ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু জনগণ তাদের অশুভ চক্রান্ত মেনে নেবে না।’
বিএনপির নেতারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা এবং তাঁর কবর নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর প্রথমে রাঙ্গুনিয়ায় তাঁর লাশ চাপা দেওয়া হয়। সেখান থেকে এক দিন পর মরদেহ উদ্ধার করে ১ জুন সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে জিয়াউর রহমানের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন লে. কর্নেল ডা. এ জেড তোফায়েল আহমেদ। তিনি জিয়াউর রহমানের শরীর থেকে ২২টি বুলেট বের করেন। মরদেহ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনার পর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা হয়। এরপর চন্দ্রিমা উদ্যানে তাঁর দাফন হয়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, যেকোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের কৌশল হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভাজন ও ভীতি জিইয়ে রাখা। বর্তমান সরকার শুরু থেকেই এ দুটি কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবেই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছে। এর আগে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের প্রস্তাব করে যে বিতর্ক তুলেছিল, সেটিও ছিল একই পরিকল্পনার অংশ।
বিএনপির নেতাদের কারও কারও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে সরকার মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়। এ ছাড়া বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করছে, সেটা যাতে দানা বাঁধতে না পারে, সে জন্য সরকার নানা কৌশল নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমানের কবর অপসারণের কথা বলা হচ্ছে; যাতে এর প্রতিবাদে বিএনপি উত্তেজিত হয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিক্রিয়া জানায়। সে রকম কিছু হলে সেটাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে আবার বিএনপিকে চাপে ফেলতে সরকারের জন্য সুবিধা হবে।
আবার নেতাদের কেউ কেউ এটাকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি দলের কূটকৌশলের অংশ মনে করছেন। তাঁরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যে সরকার বিরোধী দলকে ন্যূনতম ছাড় দেবে না, জিয়ার কবর বিতর্ককে তারই একটা বার্তা হিসেবে দেখছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, এর মধ্যে অনেকগুলো বার্তা আছে। একটি হচ্ছে, কোনো কিছুতেই যে সরকারের পরোয়া নেই, সেটা বোঝানো। বিএনপিকে উত্তেজিত করে রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনাও থাকতে পারে। আবার এত নিপীড়নের মধ্যেও বিএনপি যে টিকে আছে, তা সরকার মানতে পারছে না। সে জন্য বিএনপির আদর্শিক ভিতকে বিতর্কিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার কবর সরানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না। তাঁদের যুক্তি, সরকার নিজেই বলছে, কবরে জিয়াউর রহমানের মরদেহ নেই। সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে সরকার চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে কী সরাবে। এখন যদি কবর ঘিরে থাকা স্থাপনা সরিয়ে ফেলা হয়, সেটা প্রতিহিংসার রাজনীতিকে আরও চরমে তুলবে। কারণ, জিয়ার কবর বিএনপির নেতা–কর্মীদের কাছে অনেকটা প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এত বছর পর এগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি রাজনৈতিক হীন স্বার্থে এবং এই বিতর্ক সম্পূর্ণ অর্থহীন।’ তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, জেড ফোর্সের কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারই তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দেয়। আর জিয়াউর রহমানের লাশের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তো আছে, সেটা দেখলেই তো হয়।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ০২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,