লেখক:মোশতাক আহমেদ
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি। তবে সে তুলনায় সরকারি চাকরিতে নারীর হার পাঁচ বছর ধরে বাড়ছে না, থেমে আছে প্রায় একই জায়গায়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করা সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার ২৭ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। এ ছাড়া বিসিএসের মাধ্যমেও চাকরিতে নারীর হার খুব একটা বাড়ছে না। আবার শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। সরকারের ৭৭ জন সচিবের মধ্যে নারী মাত্র ১১ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে সরকারি চাকরিতে নারীরা পিছিয়ে আছেন। সরকারি চাকরি বদলিযোগ্য হওয়ায় এখনো অনেকের এ ব্যাপারে আগ্রহ কম। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে নারীবান্ধব কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেছেন তাঁরা।
পাঁচ বছর ধরে প্রায় একই জায়গায়
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত জুনে ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস, ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নারীর হার ছিল ২৭ শতাংশ, পরের বছর ২৯ শতাংশ। আর দুই বছর ধরে এই হার ২৮ শতাংশের ঘরেই থেমে আছে। অবশ্য মোট চাকরিজীবীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে।
বর্তমানে দেশে মোট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ১৫ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে নারী ৪ লাখ ১৪ হাজারের বেশি।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন দেশে সরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ক্যাডার সার্ভিসেও নারীরা এখন ভালো করছেন। তবে চাকরিতে নারীর হার আরও বাড়তে হয়তো সময় লাগতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি চাকরির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়,
নীতিনির্ধারণী পদসহ প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে প্রথম শ্রেণিতে মোট সরকারি চাকরিজীবী আছেন ১ লাখ ৮৪ হাজার ২২৯ জন। এর মধ্যে ২০ শতাংশ নারী। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নারীর হার তুলনামূলক কিছু বেশি; যথাক্রমে ২৮ ও ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণিতে নারীর হার প্রায় ১৮ শতাংশ।
একসময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হতো অগ্রাধিকার কোটায় (বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারী, নৃগোষ্ঠী ও জেলা কোটা)। বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হতো মেধা কোটায়। কিন্তু ২০১৮ সালে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকার। নারীদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এর একটি প্রভাব পরবর্তী বিসিএসগুলোতে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা অবশ্য আগের মতোই বহাল আছে।
বিসিএসে নারীর হার
সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিসিএসেও নারীর হার খুব একটা বাড়ছে না। ২০২০ সালে ৩৮তম বিএসএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। এই পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৩৬ শতাংশের বেশি। এই বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার পদে ২ হাজার ২০৪ জনের চাকরির জন্য সুপারিশ করেছিল পিএসসি। এর মধ্যে নারী প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদনের হারের চেয়ে নারীদের চাকরি পাওয়ার হার কম। এর আগে ২০১৭ সালে প্রকাশিত ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরির জন্য সুপারিশ পাওয়া মোট চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে নারী ছিলেন ২৬ শতাংশের সামান্য বেশি।
৩৯তম বিসিএসে (বিশেষ) কেবল চিকিৎসক নেওয়া হয়। এই বিসিএসে অবশ্য নারীদের হার পুরুষদের প্রায় সমান (নারী প্রায় ৪৭ শতাংশ)। দেশে মেডিকেল শিক্ষায়ও ছাত্রীর হার ছাত্রের চেয়ে বেশি। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ভর্তির জন্য নির্বাচিত ৪ হাজার ৩৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ২ হাজার ৩৪১ জন (৫৪ ভাগ)।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পদস্বল্পতার জন্য যাঁরা ক্যাডার পদে চাকরি পান না, তাঁদের মধ্যে থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির (নবম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেড) পদে চাকরি দেওয়া হয়। ৩৪তম বিসিএস থেকে ৩৮তম বিসিএসের তথ্য বলছে, নন-ক্যাডার পদে ৩৪তম বিসিএস থেকে নারীদের চাকরি পাওয়ার হার ২৫ শতাংশের বেশি। ৩৫তম বিসিএস থেকে প্রায় ২১ শতাংশ, ৩৬তম বিসিএস থেকে ১৯ শতাংশের বেশি, ৩৭তম বিসিএস থেকে ১৩ শতাংশ এবং ৩৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নারী নিয়োগের হার ২০ শতাংশ।
সরকারি চাকরির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের মধ্যে নারীর হার তুলনামূলক বেশি। এর মধ্যে অবশ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবেই ৬০ শতাংশ নারী নিয়োগ দিতে হয়।
বিজ্ঞাপন
নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
সরকারি চাকরিতে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরি বদলিযোগ্য হওয়ায় নারীদের বিষয়ে পরিবার থেকে একধরনের প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। দ্বিতীয়ত, এখনো সমাজের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে। গণমাধ্যমে এসেছে, এই কমিটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় মানসম্মত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, নারীদের তুলনামূলকভাবে পরিবারের কাছাকাছি পদায়ন, আবাসনের ব্যবস্থা করা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ নভেম্বর ০৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,