সপ্তাহে চার দিন কাজ আর তিন দিন ছুটি—এমন বাস্তবতা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে কাজ করা কর্মীদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের উন্নত দেশের অনেক কোম্পানি গত দুই বছরে এই ধারায় চলছে এবং এক নিরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এই নিরীক্ষায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ কোম্পানি জানিয়েছে, তারা এই ধারাতেই চলবে। খবর রয়টার্সের
নিরীক্ষাটি হয়েছে যুক্তরাজ্যে। সপ্তাহে চার দিন কাজ করলে কী হয়, তা দেখার জন্য সে দেশের ৬১টি কোম্পানি এই পাইলট প্রকল্পে অংশ নেয়। এসব কোম্পানির প্রায় তিন হাজার কর্মী জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সপ্তাহে চার দিন কাজ করেন। এই নিরীক্ষার ফলাফলে কর্মীরা এতটাই সন্তুষ্ট যে সিংহভাগ কোম্পানিই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সপ্তাহে চার দিন কাজ করার এ ধারা বজায় রাখবে।
৫৬টি কোম্পানি বলেছে, পাইলট প্রকল্পের পরও তারা চার দিনের কাজের ধারা চালিয়ে যাবে। যাদের মধ্যে ১৮টি কোম্পানি বলেছে, তারা চিরকাল এ ধারায় চলবে। দুটি কোম্পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেয়াদ বৃদ্ধি করবে। মাত্র তিনটি কোম্পানি বলেছে, কর্মসপ্তাহ চার দিনে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা তাদের নেই।
৪ ডে উইক গ্লোবাল নামের এক বেসরকারি সংস্থা গবেষণা গোষ্ঠী অটোনমি, বোস্টন কলেজ ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এই পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করেছে। এরপর দেখা গেল, চার দিনের কর্মসপ্তাহ মানুষের কর্ম ও জীবনের মধ্যে অধিকতর ভারসাম্য এনেছে। এই নিরীক্ষায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীদের মতামত, উন্নত জীবনযাপনের জন্য কর্মদিবস সপ্তাহে চার দিনই হাওয়া উচিত।
এই পাইলট প্রকল্পের ফলাফল একনজরে এ রকম—৭৩ শতাংশ কর্মী বলেছেন, তাঁরা এখন যাপিত জীবনের বিষয়ে আগের চেয়ে বেশি সুখী। ৪০ শতাংশ কর্মী বলেছেন, ঘুম নিয়ে এখন আর তেমন সমস্যা হচ্ছে না; চাকরি ছাড়ার প্রবণতা কমেছে ৬৪ শতাংশ, ক্লান্তি কমেছে ৭১ শতাংশ কর্মীর।
সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রকল্প চলকালে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব কমেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
এর আগেও চার দিনের কর্মসপ্তাহ নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়েছিল। তখনো দেখা গেছে, সপ্তাহে পাঁচ দিনের জায়গায় চার দিন কাজ করলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। শুধু তা-ই নয়, ওই সব কোম্পানির রাজস্বও বেড়েছিল।
তখন দ্য গার্ডিয়ানের এক সংবাদে বলা হয়, ইউরোপের যেসব দেশে কর্মসময় সবচেয়ে কম, সেখানেই কর্মীদের উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে কর্মসময় সবচেয়ে কম আর দুটি দেশেই কর্মীদের উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া মাইক্রোসফটের জাপান কার্যালয় যখন সপ্তাহে চার দিন কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু করল, তখন উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ বেড়ে গেল।
এদিকে যুক্তরাজ্য ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশে চার দিনের কর্মসপ্তাহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। স্পেনের বামপন্থী সরকার ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বাড়াতে গত ডিসেম্বরে একটি পাইলট প্রকল্প করে। সেখানে কর্মীদের কর্মসপ্তাহ কমিয়ে চার দিন করা হলেও বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে ইতালির বৃহত্তম ব্যাংক ইন্তেসা সানপাওলো একই বেতনে তাদের কর্মচারীদের কর্মসপ্তাহ পাঁচ দিন থেকে কমিয়ে চার দিন করে। ইস্তেসা বলেছে, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্যই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ ছাড়া জ্বালানি খরচ কমানোর জন্য পাকিস্তান সরকার কাজের সময় সপ্তাহে ছয় দিন থেকে কমিয়ে পাঁচ দিন করেছে।
বাস্তবতা হলো, মানুষ এখন কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজছে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ এখন আগের মতো ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জন দিয়ে কর্মজীবনকে প্রাধান্য দিতে চান না। সন্তানের লালন-পালনের বিষয়েও মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। মহামারির পর এ বিষয়ে আরও পরিবর্তন এসেছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোয় মানুষ বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এখন।
আধুনিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও দেখা গেছে, মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী হলে কাজে উৎপাদনশীল হয় না। বরং মানুষের জীবনে সুখ ও স্বস্তি থাকলে তার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়—এমন নজির ভূরি ভূরি দেওয়া যায় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সে জন্য মানুষকে স্বস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সেই চিন্তা থেকেই সপ্তাহে চার দিন কাজের রীতি গড়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সবখানে হবে না
ওয়াশিংটন পোস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, পাইলট প্রকল্পের ফলাফল আশাব্যঞ্জক হলেও কেউ কেউ এর বিরোধিতাও করছেন। তাঁরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব নয়, যেমন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ও শিশু যত্নকেন্দ্র। অনেক দেশে এসব খাতে ইতিমধ্যেই কর্মীর সংকট আছে। অনেক কর্মী বেশি কাজ করে বেশি অর্থ উপার্জন করতে চাইবেন—এটাও বাস্তবতা। আবার সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একদল মানুষ মনে করেন, চার দিনের কর্মসপ্তাহ করা হলে শেষমেশ মানুষের উৎপাদনশীলতা কমবে।
সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ ঘোষণা করার সময়ও অনেক বলেছিলেন, এতে মানুষের উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। কিন্তু কালক্রমে তাঁরা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন বলেই দেখা গেছে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ২২, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,