***শ্রীলঙ্কার সংকটময় পরিস্থিতিতে মুখে কুলুপ কেন চীনের-দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন (২০২২)
*** অচল হয়ে যেতে পারে শ্রীলঙ্কা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর
*** সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে আশ্বস্ত করল ভারত।
সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সময় চীনের নীরব থাকা নিয়েও আছে আলোচনা। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে দেশটির দহরম–মহরম ও নানা প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণেই এ আলোচনা বেশি। বিশেষজ্ঞরা অভিহিত করেন, চীনের অব্যাহত ঋণের কারণে শ্রীলঙ্কা ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে থাকা চীনকে নিয়ে আলোচনা বেশি। কঠিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সময় শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তার কথা বিবেচনা করছে কি না, সে বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে চীন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থাকে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন। শ্রীলঙ্কা নিয়ে চীনের অবস্থান এখন কেমন, কী বলছে দেশটি, তা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম দ্য হিন্দু একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে।
আনান্থ কৃষ্ণাণ-এর সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের সাম্প্রতিক ঋণ সমস্যার জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করছে চীন। শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তার কথা বিবেচনা করছে কি না, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দেশটি। বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, একটি বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী এবং সহযোগী অংশীদার হিসেবে আন্তরিকভাবে চীন আশা করে, শ্রীলঙ্কাকা সব খাতে দেশের ও মানুষের মৌলিক একটি স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে হবে, সেই জটিলতাকে কাটিয়ে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হবে। সবার আগে এসব করতে হবে।
এ সময় ওয়াং ওয়েনবিনের কাছে দ্য হিন্দুর সাংবাদিক জানতে চান, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সহায়তার আহ্বানের বিষয় চীন বিবেচনা করছে কি না এবং এ নিয়ে কোনো আলোচনা চলছে কি না? এর উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান ওয়াং ওয়েনবিন। তিনি বলেন, চীন শ্রীলঙ্কায় একটি টেকসই উন্নতি এবং বর্তমান জটিল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কলম্বোতে যে সরকারই আসুক না কেন তার সঙ্গে কাজ করার মতো বৃহত্তর অবস্থায় আছে বেইজিং। যেটা তারা করেছে পূর্ববর্তী সিরিসেনা সরকারের সময়েও। তবু শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ ও সহায়তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে চীন। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে ‘ঋণের ফাঁদ’ সৃষ্টির অভিযোগ আছে। এ সপ্তাহে এক হিসাবে দেখা গেছে জাপান যে ঋণ দিয়েছে তার তুলনায় মাত্র শতকরা ১০ ভাগ ঋণ দিয়েছে চীন। বেশির ভাগ ঋণ দেওয়া হয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে।
এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সাম্প্রতিক ঋণ সমস্যার জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করেছে চীন। ওয়াং ওয়েনবিন বৃহস্পতিবার ডেব্ট জাস্টিস গ্রুপের নতুন এক প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরে দেখিয়েছেন, ৪৯টি আফ্রিকা দেশের সরকারের ৬৯৬ বিলিয়ন ঋণের মধ্যে ৩৫ শতাংশ চীনের বাইরের ঋণদাতাদের এবং মাত্র ১২ চীনের। তিনি বলেন, এ তথ্যগুলোই প্রমাণ করে তথাকথিত চীন ঋণের ফাঁদ বলে পশ্চিমারা আফ্রিকার সংকটের জন্য চীনকে দায়ী করে যা বলে, তা বিভ্রান্তির বক্তব্য।
চীনের সরকারি গণমাধ্যম চায়না ডেইলি শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, ‘কিছু পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ভ্রান্ত উদ্দেশ্য নিয়ে শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য চীনকে দায়ী করার চেষ্টা করে চলেছেন। জাপান ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পর শ্রীলঙ্কার ঋণদাতাদের মধ্যে চীন তৃতীয় স্থানে। আর চীনের ঋণের পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ।
গণমাধ্যমটি গোতাবায়া রাজাপক্ষ সরকারের সমালোচনা করে বলেছে, তাঁর ত্রুটিপূর্ণ নীতি ‘দুর্ভোগ বাড়িয়েছে’ দেশটিতে। কর কমানো এবং সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা বা গণমাধ্যম রাজাপক্ষদের কোনো সমর্থন দেয়নি।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ বিনিথা রেভি। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থায় চীন বিচ্ছিন্ন থাকতে ইচ্ছুক এবং অপেক্ষা করে পরিস্থিতি দেখে মন্তব্য করার নীতিতে আছে। ভারত ও চীন উভয়ই শ্রীলঙ্কায় (বর্তমান পরিস্থিতি) ঘটনা ঘটতে দিচ্ছিল। শ্রীলঙ্কা নিয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন খেলাও ছিল। ইতিহাস, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখে এ ক্ষেত্রে ভারতকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। চীন আবার আরও বাস্তববাদী। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তারা খুব দ্রুত সেখানে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। চীনা বিনিয়োগকে না বলা যেকোনো সরকারের পক্ষেই কঠিন হয়।
অচল হয়ে যেতে পারে শ্রীলঙ্কা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর
শ্রীলঙ্কার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দেশটিতে এখন কার্যত কোনো সরকার নেই। এই বাস্তবতায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বিক্রমাসিংহের সতর্কবাণী, দেশে স্থিতিশীল সরকার না আসলে পুরো শ্রীলঙ্কা বন্ধ বা শাটডাউন হয়ে যেতে পারে।
তবে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকায় পেট্রোলের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কেনা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। আবার আইএমএফের কাছ থেকে বেইল আউট চাচ্ছে দেশটি। কিন্তু দেশে শক্তিশালী সরকার না থাকলে সেই আলোচনাও কতটা আলোর মুখ দেখবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। খবর বিবিসির
অর্থনৈতিক সংকটে কারণে গণবিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারফিউ জারি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বার অর্পণ করেছেন সেনাবাহিনীর হাতে। তবে শ্রীলঙ্কার অনেক মানুষ মনে করেন, বর্তমান এই সংকটে রনিল বিক্রমাসিংহেরও হাত আছে। ফলে অনেকে আবার তাঁর পদত্যাগ দাবি করছেন।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কার্যত ধসে পড়েছে। খাবার, জ্বালানিসহ অন্যান্য মৌলিক দ্রব্যাদির দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
নন্দলাল বিক্রমাসিংহেও চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, স্থিতিশীল সরকার ছাড়া কীভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে, তার কোনো পথ দেখছেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা তিন জাহাজ ডিজেলের অর্থায়ন করেছি, সামনে হয়তো আরও দুই-এক জাহাজের অর্থায়ন আমরা করতে পারব। কিন্তু এরপর আমাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর সেটা যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে পুরো দেশ অচল হয়ে পড়বে। মোদ্দা কথা হলো, পুরো দেশ বন্ধ হয়ে যাবে। সে জন্য আমাদের একজন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা প্রয়োজন, যাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন…তা না হলে মানুষ ভুগবে’।
আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য
বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চাপে নুয়ে-পড়া শ্রীলঙ্কায় আলুর দাম প্রতি কেজি ৪৩০ শ্রীলঙ্কার রুপি। এই বিপুল পরিমাণ দাম দিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য এবং সবজি কিনে খেতে হচ্ছে সে দেশের মানুষকে। আগের দামের তুলনায় বর্তমান দামে আকাশ-পাতাল তফাত।
২০১৯-এর নভেম্বরে বিভিন্ন পণ্যের যে দাম ছিল, মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে তা হয়েছে আকাশছোঁয়া। তবে সব থেকে বেড়েছে ডালের দাম, প্রায় ৪১৭ শতাংশ। আগে শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় প্রতি কেজি ডালের দাম ছিল ১২০ রুপি। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬২০ রুপি। আগে আলুর দাম ছিল ২৪০ রুপি, এখন তা ৭৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৩০ রুপি। ব্যাপক হারে বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য চিনির দামও। এক ধাক্কায় ১০০ রুপি থেকে বেড়ে ৩৪০ রুপি প্রতি কেজি। চালের দাম বেড়েছে ১৪৪ শতাংশ-৯০ থেকে বেড়ে ২২০ রুপি। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে মাছ, কাঁচালঙ্কা, নারকেল তেল, নারিকেলসহ একাধিক পণ্যের দাম। তবে আগের তুলনায় দাম কমেছে লাল পেঁয়াজের।
সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে শ্রীলঙ্কাকে আশ্বস্ত করল ভারত
শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়ে দেশটিকে আশ্বস্ত করেছে ভারত। নজিরবিহীন রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার কারণে এখন জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দ্বীপরাষ্ট্রটি। খবর দ্য হিন্দুর।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্দেনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আজ শনিবার এই আশ্বাস দেন ভারতীয় হাইকমিশনার গোপাল বাগলে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগপত্র গ্রহণের এক দিন পর স্পিকারের সঙ্গে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
এক টুইটে ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, বৈঠকে বিশেষ করে এই জটিল সন্ধিক্ষণে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক কাঠামো বহালে পার্লামেন্টের ভূমিকার প্রশংসা করেন হাইকমিশনার বাগলে।
ভারতীয় মিশন আরও লিখেছে, শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে (ভারতের পক্ষ থেকে) সমর্থন জানিয়ে যাওয়ার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়।
গত সাত দশকের মধ্যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মুদ্রার মারাত্মক স্বল্পতার কারণে দেশটির খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
২ কোটি ২২ লাখ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে আগামী ছয় মাসে ভারতের দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্রটির ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। নিত্যপণ্যের স্বল্পতা ও লোডশেডিংয়ের কারণে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জনগণ।
চলতি বছর শ্রীলঙ্কার বিদেশি সহায়তার প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে ভারত। এখন পর্যন্ত ভারত ৩৮০ কোটি ডলার সমপরিমাণের সহায়তা দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত ও সরবরাহ করেছে বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ১৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,