লেখক: ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স।
নিউইয়র্কের বাফেলোতে গত ১৪ মে পেটন গেনড্রোন নামের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী এক যুবক বেছে বেছে গুলি করে ১০ জন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেন। তিনি তাঁর হেলমেটের সঙ্গে ক্যামেরা লাগিয়ে নিয়েছিলেন এবং এই হত্যাদৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট টেক্সাসের এল পাসোতে ওয়ালমার্ট সুপার শপে ঢুকে বেছে বেছে ২৩ জন কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গকে হত্যা করেছিলেন প্যাট্রিক উড ক্র্যাসিয়াস নামের এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ। এর আগে ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর পেনসিলভানিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি ইহুদি উপাসনালয়ে ঢুকে প্রার্থনারত ১১ জন ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন রবার্ট বাওয়ার নামের একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি, যিনি নিজেকে অভিবাসনবিরোধী হিসেবে দাবি করেছিলেন। এরও আগে ২০১৫ সালের ১৭ জুন দক্ষিণ ক্যারোলাইনায় ড্রাইলান রুফ নামের আরেক শ্বেতাঙ্গ তরুণ আফ্রিকান-আমেরিকানদের একটি গির্জায় ঢুকে নির্বিচার গুলি করে ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেছিলেন। তিনি নিজেকে নব্য-নাৎসিবাদী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।
পেটন গেনড্রোন, প্যাট্রিক উড ক্র্যাসিয়াস, রবার্ট বাওয়ার এবং ড্রাইলান রুফের মতো অনেক আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ মনে করছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই একটি গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছেন। তাঁরা জানেন, ২০৪০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কালো এবং বাদামি চামড়ার মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তারা যাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর না হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য তাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়াই এই বর্ণবাদী ও অভিবাসীবিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্য।
পেটন গেনড্রোন, ক্র্যাসিয়াস, বাওয়ার এবং রুফের মতো লোকেরা ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরি’ নামের একটি তথাকথিত আদর্শে সম্মিলিতভাবে বিশ্বাসী। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, নানা দেশের অভিবাসীদের পশ্চিমা দেশগুলোতে এনে শ্বেতাঙ্গদের জায়গায় তাদের বসিয়ে দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে। এটিকে তারা ‘সাদা নির্মূলের চক্রান্ত’ হিসেবে দেখছে। এ কারণেই তারা কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জায় উপাসকদের ওপর, সিনাগগে ইহুদি উপাসকদের ওপর, ওয়ালমার্টে আসা সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এ জঘন্য হামলার মধ্য দিয়ে তারা বলতে চাইছে, শ্বেতাঙ্গরা এ পরিবর্তনশীল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা লড়াই ঘোষণা করেছে। তারা মনে করছে, এত দিন যে আমেরিকান ধাঁচের শ্বেতাঙ্গ অস্তিত্ব এবং পশ্চিমা সভ্যতা ছিল, তা এখন হুমকির মুখে।
বাফেলোতে স্বঘোষিত ‘ইকো-ফ্যাসিস্ট ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট’ পেটন গেনড্রোন এবং তাঁর সমমনারা কালো লোকদের হত্যা করাকে পরিষ্কারভাবে গৃহযুদ্ধের মধ্যে চলা একটি অনিবার্য সংঘর্ষ মাত্র মনে করে। কালো, বাদামি, এবং আদিবাসী—সব অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরা ইতিমধ্যে বিশ্বের এ পরিবর্তন অনুভব করতে পারছেন। গেনড্রোন বাফেলোতে গুলি চালানোর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, তিনি একজন ‘ফ্যাসিস্ট’। তিনি লিখেছিলেন, ‘ফ্যাসিবাদই একমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা পুনর্বাসিত অশ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে দিতে সক্ষম।’
আমেরিকানরা গত ১৫ বছরে ক্রমবর্ধমানভাবে দেখেছে, ক্যাপিটল হিলসহ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এমন অনেক রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যাঁরা গেনড্রোনের মত পোষণ করেন। ‘সাদাদের দেশ বহুবর্ণের মানুষের দেশে পরিণত হয়েছে’ বলে যে ধারণা আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তারা সে ধারণা কিছুতেই মানতে পারছে না। ১৮৬৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের স্লোগান ছিল ‘হোয়াইট ম্যান’স কান্ট্রি। লেট হোয়াইট মেন রুল’ (সাদাদের দেশে সাদাদের শাসক গড়ুন)। আজকের নব্য শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সেই স্লোগানমুখর দিন ফিরিয়ে আনতে চান। আর তঁাদের চেতনাকে পরিচালিত করার প্রধান চালিকা শক্তি হলো ঘৃণা।
শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে যারা নগ্নভাবে সাদাদের আধিপত্যে বিশ্বাস করে, তাদের মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি বিশাল আইসবার্গের দৃশ্যমান ক্ষুদ্র চূড়া মাত্র। গেনড্রোনের ক্রিয়াকলাপগুলোকে মানসিক অসুস্থতার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তিনি যা করেছেন, তা একেবারে বিচ্ছিন্ন একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো সন্ত্রাস নয়। তিনি একটি ভয়ানক তথাকথিত আদর্শ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ নিধনে নেমেছিলেন। গেনড্রোন, বাওয়ার এবং ক্র্যাসিয়াস ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি বা অশ্বেতাঙ্গ, এমনকি শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও যাঁরা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরোধিতা করেন—তাঁদের সবার বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠী কু ক্লাক্স ক্লান থেকে শুরু করে নব্য নাৎসিরা আমেরিকান পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্য থেকে শুরু করে গেড্রোনের মতো ঠান্ডা মাথার গণহত্যাকারীদের ওপর ভর করেছে।
১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বেঁধেছিল যে পরিস্থিতির কারণে, তার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি অনেক খারাপ। কিন্তু এ কথা কেউ সাহস করে বলছে না। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থান ও কৃষ্ণাঙ্গবিরোধিতা বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে। এখনই যদি মার্কিন সমাজ সেই হুঁশিয়ারিমূলক সংকেতকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেয়, তাহলে অচিরেই আমেরিকান সমাজে বড় ধরনের বর্ণভিত্তিক সহিংসতা লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়বে, যা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
****আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রভাষক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুন ০৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,