হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (জন্মঃ- ১৬ জুন, ১৯২০ – মৃত্যুঃ- ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯)
১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। শেষতক ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদিগো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে গান গাইবার জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে, সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত, হেমন্তকে দিয়ে, ফাইয়াজ হাস্মির কথায়ে “কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে” ও “ও প্রীত নিভানেভালি” গাওয়ালেন।
১৯৪১ সালে এই শিল্পী তাঁর প্লে-ব্যাক সংগীত জীবন শুরু করেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির মাধ্যমে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। ফলে দর্শক-শ্রোতা একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান উপহার পেয়েছেন। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দী গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত চিনিয়েছিলেন হেমন্ত। একই বছরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নিজের কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন। তবে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমাতে। এছাড়াও কলম্বিয়ার লেবেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন তিনি। তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত নিজেকে সম্ভাবনাময় শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে বলিউডি সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান করেছিল এবং এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা।
ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের সাথে বেলা মুখপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। ১৯৪৩-এ বাংলা ছায়াছবি, কাশিনাথে, সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন, কিন্তু বিবাহের পর তিনি আর সঙ্গীত জগৎ এ প্রবেশ করলেন না।
জম ও শিক্ষা
তাঁর জন্ম বারাণসীর শহরে। তাঁর পরিবার কলকাতায় আসে বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে। ভবানিপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে ছাত্র ছিলেন যখন, সেখানেই ওনার বাল্যবন্ধু ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয়। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু, তিনি সঙ্গীতের জন্য আপন শিক্ষা ত্যাগ করেন। তাঁর সাহিত্যিক হবার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন, তিনি দেশ এর জন্যে লেখেন। ১৯৩৭ থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে ভূষিত করে, তিনি এই পদক প্রত্যাখান করেন। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসে এই গানটি শুনিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলার মানুষের হৃদয়ে যে এই শিল্পীর স্বরলিপি চিরদিনের জন্য খোদাই করা হয়ে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
………….
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুন ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,