বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্মঃ- ১৮ মার্চ, ১৯১২ – এবং মৃত্যুঃ- ২ ডিসেম্বর , ১৯৯১
কেন লিখি-বিমল মিত্র। …সালটা বোধহয় ১৯২৪ কি ১৯২৫। আর কালটা বোধহয় কার্তিক মাস। অর্থাৎ দুর্গাপুজো কেটে গিয়ে, কালীপুজোও কেটে গেছে। অগ্রাহয়ণ তখন পড়বে-পড়বে। দেখলাম অনেক পত্রিকাবাহী সেই ঠেলাগাড়িটা আমাকে কাছে যেতে দেখে থেমে গেল। আমি দেখলাম, বসুমতী, ভারতবর্ষ, প্রবাসী প্রভৃতি সেকালের নামী দামী চালু পত্রিকা সাজানো। কিন্তু দাম বড় বেশি। আট আনা করে এক একটা। আমি অপেক্ষাকৃত সস্তার পত্রিকা খুঁজে একটা পত্রিকা হাতে তুলে নিলাম। সেখানার নাম ‘বাঁশরী’, সম্পাদক শ্রীনরেন্দ্রনাথ বসু। দাম বোধহয় মাত্র চার আনা। তা চার আনা পয়সার দাম সে যুগে অনেক। আমি দাম দিয়ে পত্রিকাখানা হাতে নিয়ে আবার আমার কামরায় এসে বসলাম আর পত্রিকাটির পাতা ওল্টাতে লাগলাম। ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ একটা জায়গায় এসে থেকে গেলাম। একটা ছোট কবিতা, পত্রিকাটির পাতার ডানদিকে পাদপূরণ হিসেবে সেটি ব্যবহৃত হয়েছে। সে যুগের রীতি অনুযায়ী ছন্দ মিলিয়ে লেখা। কবিতাটির লেখকের নাম মনে নেই। এমন কি কবিতার একটি লাইনও মনে নেই এখন। তবে এইটুকু মনে আছে যে কবিতাটির আশে-পাশে অনেকখানি খালি জায়গা পড়ে ছিল। কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার হঠাৎই মনে হোলো আমি যেন নিজেও চেষ্টা করলে এ-রকম কবিতা লিখতে পারি। পকেটে তখন আমার কাগজও নেই, ফাউন্টেন পেনও নেই। আর এখনকার মত তখন ফাউন্টেন পেনেরও এত প্রচলন ছিল না। তবে তখনকার রীতি অনুযায়ী ছিল মাত্র একটা পেনসিল। সেই পেনসিলটা দিয়েই সেই কবিতার ফাঁকা জায়গাটুকু একটা কবিতা লিখে ভর্তি করে ফেললাম। অক্ষম মিল, অক্ষম কাব্য, অক্ষম প্রচেষ্টা। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? সেই চলন্ত ট্রেনের সে যুগের নিরিবিলি সেকেন্ড-ক্লাস কামরার মধ্যেই সে রাতে আমার জীবনের প্রথম কবিতা সৃষ্টি হলো।…
সৃষ্টিশীল সাহিত্য-রচনার অনবচ্ছিন্ন ব্যস্ততার মধ্যেও প্রত্যেক লেখকের জীবনে কিছু না কিছু বিভ্রান্তিকর ঘটনা ঘটে। সেই বিভ্রান্তির কবলে পড়ে অনেকবার আমারও ধ্যানভঙ্গ হবার আশঙ্কা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক মানুষ হওয়ার অপরাধে সমস্ত কিছু আমি নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ব্যস্ততা এবং শারীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি স্বীকার করেও এমন কিছু রচনা আমাকে লিখতে হয়েছে যা আমার ইচ্ছানুকূল নয়।…নিজের সম্বন্ধে নিজের কলমে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার কোনও কালে ছিল না এবং এখনও নেই।…
…সাহিত্যের সার্থকতা কীসে তা নিয়ে পৃথিবীতে নানা প্রশ্ন নানা মানুষের মনে উদয় হয়েছে। সাহিত্য কি যশের জন্যে, না অর্থের জন্যে? না কি আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে? সাহিত্যের সংজ্ঞা দিয়ে কখনও কোনও পণ্ডিতদের মধ্যে বিরোধ বাধেনি সত্য, কিন্তু সাহিত্যিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে তাঁদের আচরণে আর আদর্শে আকাশ-পাতাল প্রভেদ দেখে অনেকে অবাক হয়েছেন।
লেখার মধ্যে যাঁদের সত্ত্বগুণের পরিচয় থাকে, ব্যক্তিগত জীবনে হয়ত তাঁরা তামসিক আচরণ করেন।
জীবন আর জীবিকা কি সকলের এক?
…রবীন্দ্রনাথ একবার লিখেছিলেন যে প্রত্যেক লেখকের প্রত্যেক গল্পের নায়ক সেই লেখক নিজেই। কথাটা মিথ্যে নয়।…
…আমি বরাবরই আড়ালে থাকার মানুষ। যারা আমার মত আড়ালে থেকে শান্তি পায় তারা স্বভাবতই ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। আর মজা এই যে তারা ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায় বলেই হয়ত যত ঝামেলা তাদের ঘাড়েই এসে পড়ে। আসলে সংসারে থেকে যারা ঝামেলা এড়াবার চেষ্টা করে তারা নির্বোধ। ঘটনাচক্রে আমিও সেই নির্বোধের দলে। এই নির্বুদ্ধিতার জন্যেই সংসারে এত ভাল ভাল পেশা থাকতে কিনা সাহিত্যিকের পেশা করে নিয়েছি।…
…নিঃসঙ্গতার অনেক পীড়ন আছে। একা-একা থাকবার যন্তণা তারাই বোঝে যারা একা একা থাকে। অসংখ্য সঙ্গীর দ্বারা পরিবৃত থেকেও যে এক ধরনের একাকিত্ব বা এক ধরনের নিঃসঙ্গতা তা আমাকে মাঝে মাঝে বিকল করে দিত। কিন্তু সব জিনিসেরই যেমন একটা উপকারিতা আছে, নিঃসঙ্গতারও তেমনি একটা ভালো দিক আছে। সেটা হচ্ছে এই যে নিঃসঙ্গতা মানুষকে ভাবায় বা ডিসটার্ব করে। চারপাশের পৃথিবী তাকে খুশী করে না। সে এর সংস্কার চায়, সে এর পরিবর্তন চায়। এই সংসারকে সে নতুন চেহারায় দেখতে চায়। যে মানুষগুলো তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে তাদের দোষ-ত্রুটি তার নজরে পড়ে। মনে হয় এরা যেন অন্য রকম হলে ভালো হতো। সে ভাবে কিসে মানুষ সুখী হয়, কিসে মানুষের সমাজ, মানুষের রাষ্ট্র, প্রত্যেকটি মানুষের চরিত্র আরো সুশৃঙ্খল হয়। যদি তার নিজের ইছেমত মানুষ বা সমাজ বা রাষ্ট্র না থাকে তখন সে বিদ্রোহ করে নয়তো সে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।…
…ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস সম্বন্ধে আমি ভারি সতর্ক ছিলাম। সেটা লেখক-জীবনের পক্ষে অপরিহার্য বলে মনে করছি। সেটা হচ্ছে – সংযম। আমি জীবনে বিরাট মহীরুহের পতন যেমন দেখেছি, আবার তেমনি দেখেছি গুণীর বিশ্বজয়। যখন তাদের পতন উত্থানের হিসেব নিকেশ করছি তখন একটা মাত্র জিনিসের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। সেটা হয় সংযমের অভাব নয় তো অতি সংযম। জীবনে পতনের সুযোগ তো পদে পদে। কিন্তু উত্থান? উত্থানের সুযোগও আসে অনেকবার। কিন্তু সেই উত্থানের সময়ে লোভ-মোহ-লালসা ত্যাগ করবার কথা কয়জনের মনে আসে?…
…শেষকালে একদিন কেন জানি না মনে হোলো যে, লিখে কিছু হয় না, লেখা কেউ পড়ে না, এবং লেখার কোনও পারমার্থিক মূল্যও নেই। সুতরাং লেখা ত্যাগ করে একদিন কলকাতা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলাম। তারপর জগৎ এবং জীবন সম্বন্ধে যখন কিছু প্রজ্ঞা হয়েছে বলে মনে হলো তখন কলকাতায় ফিরে এসে দেখি এখানকার আবহাওয়া ফিরে গেছে। একজন পুরোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতেই সে অবাক হয়ে গেল। বললে – কী হে, কোথায় ছিলে এ্যাদ্দিন?
নিজের অনুপস্থিতির কারণ বলার পর সে বললে – তা এখন আবার লেখো না, এখন তো লেখার খুব কদর হচ্ছে, এখন বাজারে তো আবার বই-টই বিক্রি হচ্ছে খুব –
খবরটা আমার কাছে একটা আবিষ্কারের মতন। ঠিক করলাম লিখবো।…
(বাবা) বলেছিলেন – তাহলে তুমি বড় হয়ে করবেটা কী?
আমি বলেছিলাম – আমি বাঙলায় এম-এ পড়বো-
– বাঙলায় এম-এ পড়ে কী হবে? ইস্কুল-মাষ্টার?
আমি বলেছিলাম – না, আমি লেখক হবো-
বাবা বলেছিলেন – লেখক হবে মানে? লেখক হলেও তো তোমাকে দিনের বেলা একটা বাঁধা মাইনের চাকরি করতে হবে?
আমি বলেছিলাম – না। লেখক মানে লেখক। হোল-টাইম লেখক, সেন্ট পার্সেন্ট লেখক। আমি চাকরি করা পার্ট-টাইমের স্লেভ্-লেখক হতে চাই না।
বাবা নিজের যুক্তিকে জোরদার করবার জন্যে প্রায়ই বলতেন – সংসারে বড় হতে গেলে নিজের ঢাক নিজে পেটাতে হয়, পদস্থ লোকের মনস্তুষ্টি-সাধন করতে হয়। অসত্য হলেও সকলের প্রিয় কথা বলতে হয়, দশজনের সঙ্গে মেলামেশা করে দশের একজন হয়ে দল বাঁধতে হয়, তবে তো মানুষ বড় হয়। তুমি মুখচোরা হলে ও-সব করবে কী করে? তুমি লেখক হবে বলছো, তা ও-লাইনেও নিশ্চয়ই দলাদলি আছে, তোমাকে সম্পাদকের সঙ্গে দহরম-মহরম করতে হবে, প্রকাশকদের দরজায় ধর্না দিতে হবে, যারা প্রাইজ দেয় তাদের বাড়িতে গিয়ে স্তাবকতা করতে হবে – তদ্ধির-তদারক ছাড়া নোবেল-প্রাইজও পাওয়া যায় না, তোমার মত মুখচোরা মানুষ কি ওসব পারবে?
আমি বলেছিলাম – আমি ও-সব চাই না – আমি শুধু নিজের বাড়িতে বসে লিখবো-
বাবা বলেছিলেন – তাহলে তোমার কিছুই হবে না –
…সত্যিই আমার কিছু হয়নি। অবশ্য তা নিয়ে আমি দুঃখও করি না। কারণ জীবনে যে কিছু হতেই হবে তারই বা কী মানে আছে। আকাশের আকাশ হওয়া কিংবা সমুদ্রের সমুদ্র হওয়াটাই তো যথেষ্ট। লেখক আমি হতে না-ই বা পারলাম, মূলতঃ আমি একজন মানুষ। মানুষ হওয়াটাই তো আমার কাছে যথেষ্ট ছিল। কারণ তরুলতা অরি সহজেই তরুলতা, পশু-পাখি অতি সহজেই পশু-পাখি, কিন্তু মানুষ অনেক কষ্টে অনেক দুঃখে অনেক যন্ত্রণায় অনেক সাধনায় আর অনেক তপস্যায় তবে মানুষ। আমি কি সেই মানুষই হতে পেরেছি?
………………………….
জন্ম
জন্ম কলকাতায়।
পিতা সতীশচন্দ্র মিত্র।
শিক্ষা : চেতলা স্কুল, আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
রেলে চাকরি করতে করতে সাহিত্যচর্চা। প্রথম উপন্যাস ‘চাই’। পাঁচের দশকের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এরপর রেলের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যসৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত উপন্যাস ‘একক দশক শতক’, ‘চলো কলকাতা’ ‘পতি পরম গুরু’ ইত্যাদি। প্রায় পাঁচশোটি গল্প ও শতাধিক উপন্যাসের লেখক বিমল মিত্র তাঁর ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গ্রন্থের জন্য ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। তাঁর রচনা ভারতের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।
পুরস্কার ও পদক সমূহ
‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬৪) পান ।
উপন্যাস
চাই
একক দশক শতক
সাহেব বিবি গোলাম
কড়ি দিয়ে কিনলাম
বেগম মেরী বিশ্বাস
চলো কলকাতা
পতি পরম গুরু
এই নরদেহ
এরই নাম সংসার
মালা দেওয়া নেওয়া
তোমরা দুজনে মিলে
গুলমোহর
যা দেবী
আসামী হাজির
………………
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা ।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ১৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,