শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী ও সাধক, ভারতরত্ন উস্তাদ বিসমিল্লা খানের জন্মঃ- ২১ মার্চ, ১৯১৬ – মৃত্যুঃ- ২১ আগস্ট, ২০০৬
শুধু একার প্রয়াসে সানাইকে দেশের জনপ্রিয়তম উচ্চাঙ্গ ধ্বনি করে তুলেছেন। যত ডাক বেড়েছে, ততই বেড়েছে ধ্যান ও চর্চা। তাঁর দীর্ঘ জীবনে স্বীকৃতি পাওয়াটাও তাঁর প্রিয় যন্ত্রটির স্বীকৃতি পাওয়ার মতোই ধাপে ধাপে। সদ্য যৌবনে, ১৯৩০-এ, ইলাহাবাদ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সেরার পুরস্কার পেলেন। ১৯৩৭-এ ওই সম্মেলনেই পর পর তিনটি পদক পেলেন। প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বাজানোর চোদ্দো বছর পর ১৯৬১-তে পেলেন পদ্মশ্রী। ১৯৬৮-তে পদ্মভূষণ। এবং ২০০৬-এ মৃত্যুর কিছু কাল আগে ভারতরত্ন। তাঁর মৃত্যুর দিনটিকে ভারত সরকার জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করেছিলেন। একুশটি গান স্যালিউটের সঙ্গে ওঁর মরদেহকে কবর দেওয়া হয় পুরোনো বারাণসীর ফতেমাইন গোরস্থানে একটি নিম গাছের নীচে। কবরে ওঁর সঙ্গী হয় ওঁর প্রিয় একটি সানাই। যাদের বেগম বলে ডাকতেন তাদের একটি।
শহর কলকাতা উস্তাদের অগণিত সেরা অনুষ্ঠানের সাক্ষী। যার একটি সত্তর দশকে কলামন্দিরে রেডিয়ো সঙ্গীত সম্মেলনের অনুষ্ঠান। বাজিয়েছিলেন বেহাগ। খেয়াল অঙ্গের বাজনায় সেদিন কিছু তান করেছিলেন, যা ভোলার নয়। রেডিয়োর সংগ্রহশালায় যদি সে বাজনা থেকে থাকে তবে এই এক শত এক পূর্তিতে তা বাজানোর স্বর্ণিল সময় এল।
কলকাতা সাক্ষী বিসমিল্লা-বিলায়েতের এক ঐতিহাসিক যুগলবন্দির, ১৯৭৭-এর শেষ বসন্তে, নেতাজি ইন্ডোরে। উস্তাদরা বাজিয়েছিলেন ইমন, বেহাগ, খাম্বাজ। বার কয়েক সেদিন বিলায়েৎ খান নানা বন্দিশ গেয়ে দিয়েছিলেন, এবং সেই সুরের জবাবে বিসমিল্লা খান যেভাবে সুরে বাড়ছিলেন তা বোঝানোর একমাত্র উপায় সেই সন্ধ্যার টেপটা বাজানো।
উস্তাদ বিসমিল্লা খান-এর কথা যখন, এ লেখা হয়ে পড়বে স্মৃতির খেলা। খান-এর সাহেবের যে কোনও রেকর্ড বাজালে এত স্মৃতি তোলপাড় করে কেন? ভারতীয় জীবনের এত এত অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সঙ্গে কেন বিসমিল্লা জড়িয়ে? কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির কী কলকাতার নাখোদা মসজিদে গেলে কেন স্মরণে আসেন বিসমিল্লা? বিলায়েৎ খানের সঙ্গে জোড়ে বাজানোর প্রসঙ্গ উঠলে কেন বিসমিল্লা? সত্যজিতের ‘জলসাঘর’-এর আসরের দৃশ্য মনে করলে কেন সেখানে সশরীরে, ঠোঁটে সানাই তুলে বিসমিল্লা? কিংবা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭ দিল্লির লাল কেল্লার শিখরেও তো বিসমিল্লা!
তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন বারাণসীর সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে আরেক কাশীপুত্রের স্মৃতি তুলে আনতে হয়। যাঁর নাম রবিশঙ্কর। ১৯৭৭-এর শীতকালে কাশীর গঙ্গায় নৌকাবিহারে বেরিয়েছেন রবিশঙ্কর, তাঁর সঙ্গী নগরীর পণ্ডিতকুল। একের পর এক ঘাট পেরিয়ে যাওয়া হচ্ছে, রবিশঙ্কর কাশীতে ওঁর বাল্যস্মৃতির কথা বলছেন। একটু পর দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িগুলোর দিকে চেয়ে রবিশঙ্কর বললেন, ‘এই সব মন্দিরের গায়ে থাকেন বিসমিল্লা খান।’
বারাণসী এবং বিসমিল্লা বারাণসীর এপিঠ-ওপিঠও নন, একই পিঠ। বিহারের দুমরাওয়ের এক উপনগরীতে জন্ম বিসমিল্লার। তবে জীবন শুরু বলতে যা বোঝায় তা ঘটল বাল্যে সানাই হাতে কাকা আলি বক্স-এর সঙ্গে বারাণসী পাড়ি জমিয়ে। আলি বক্স তখন সেখানে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সানাই শিল্পী। আর সেই যে শুরু তার যেন আর শেষ নেই। বাকি জীবন ধরে শিল্পী হিসেবে যতই মহৎ হয়ে উঠেছেন ততই শিকড় গেড়েছেন বারাণসীতে।
আর সেই বারাণসী বলতে ওঁর বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা দু’টি দৃশ্য। এক, স্থির হয়ে ধ্বজা উঁচিয়ে দাঁড়ানো বিশ্বনাথ মন্দির। দুই, দিনে ও রাতে শতরূপা গঙ্গা। যার অনেকটা মেজাজ ধরা আছে উস্তাদকে নিয়ে গৌতম ঘোষের অপূর্ব তথ্যচিত্র ‘মোমেন্টস উইথ দ্য মায়েস্ত্রো’য়। সেখানে কবি-পুলিশ আয়ান রশিদ খানের কিছু প্রশ্নের জবাবে এমন সব কথা জুগিয়েছেন বিসমিল্লা যা তাঁর অমৃত ‘ফুঁ’ ও বাজানো সুরের মতো দর্শক-শ্রোতাকে ক্রমশ মহবুস অর্থাৎ কয়েদ করে ফেলে। যেভাবে মন্দির ও গঙ্গায় মহবুস ছিলেন উস্তাদ স্বয়ং। বরাবরই কথার ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যেত গঙ্গায় আর মন্দিরে।
খান সাহেবের একটা কথা নিয়ে খুব রোমন্থন হয় ভক্তসমাজে। তা হল মার্কিন দেশে বেশ চেষ্টা চলেছিল ওঁকে ওখানে প্রচুর টাকাকড়ি ধরিয়ে লম্বা সময় রেখে দেবার জন্য। তাতে ওঁর সরল উত্তর ছিল: টাকার কথা ছাড়ুন। কাশী থেকে গঙ্গা আর বিশ্বনাথ মন্দির উঠিয়ে এখানে এনে পাতুন, তাহলে আছি।
কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় জানালা দিয়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদ দেখতেন শেহনাই-নওয়াজ। একবার এক সংগঠনের হয়ে ওঁর প্রোগ্রামের কথা পাড়তে গেছি মসজিদের উল্টো দিকের হোটেলে।
দেখি সেভাবে শুয়ে উস্তাদ সমানে স্টেট এক্সপ্রেস ফাইভ ফাইভ ফাইভ সিগারেট টানছেন আর থেকে থেকেই মসজিদ দেখছেন। কথা শুরুর আগেই বলতে গেলে প্রোগ্রামে রাজি হয়ে গেলেন। কেন? না, আবার মসজিদ দর্শনে আসা যাবে কলকাতা।
প্লেনের টিকিটের কথা তুলতেই বলে উঠলেন, ‘আরে না রে না। আমার প্লেন চলে না, আমি রেলেই আসব-যাব। আর ব্যবস্থা করো এই হোটেলের এই ঘরের। বাকি সব তো আল্লার ইচ্ছা!’
বলতেই হল, ‘বিদেশ গেলে তো রেল পান না। কষ্ট হয়?’
বললেন, ‘ওই জন্যই বিদেশ বিদেশ। আমাদের পূরব-অঙ্গ গানে বিদেশ যাওয়া নিয়েই তো কত কান্নার গান বাঁধা হয়ে যায়। গ্রাম ছেড়ে শহরে কী শহর ছেড়ে অন্য শহরে কেউ গেলেই তো বিদেশ লেগে যায়।’
বলেই গুনগুন করে একটা চৈতির সুর ভাঁজতে লাগলেন উস্তাদ।
ইচ্ছে হল একবারটি বলি রবিশঙ্কর কী বলেছেন ওঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণায়, কিন্তু লজ্জা হল। ভাবলাম কেনই জানি না, ভাবলাম ঈশ্বর বা আল্লার প্রশংসা ছাড়া আর কারও প্রশংসা শুনতে ওঁর ভাল লাগবে না। কিন্তু কী বলেছিলেন রবিশঙ্কর?
বলছেন, ‘ভালবাসা পাওয়াটার চেয়েও গানে ভালবাসা দেওয়াটা অনেক বড়। অবশ্য যে দেয় সে তো ভালবাসা পাচ্ছেই। শুভলক্ষ্মীর কথায় কথায় মনে পড়ছে, এই ভালবাসা দেওয়া এবং পাওয়ার একটা বিরাট দৃষ্টান্ত বিসমিল্লা। দেখো, বছরের পর বছর লোকটা বাজিয়ে যাচ্ছে, কী সুন্দর, কী চমৎকার, তার মধ্যে কতখানি ভালবাসা মেশানো থাকে, লোকে ভালওবাসে তা। অনেকে হয়তো বলবে, বলেও যে, সে রকম রাগ-রাগিণীর বিরাট কিছু অ্যাসেম্বলি বা আয়োজন নেই। কিন্তু ভগবানদত্ত ওই যে একটা ফুঁ একটা অন্য স্তর সৃষ্টি করে গেল লোকটা। কত লোকেই তো সানাই বাজিয়েছে, কিন্তু সানাই-বাজিয়ের স্থান কোথায় ছিল? সেই বিয়ের মণ্ডপে, কিংবা প্রসেশনে। কিন্তু বিসমিল্লা সেটাকে এমন পাতে তুলে দিয়েছেন যে, লোকে সানাইকে ক্লাসিকাল সঙ্গীত হিসেবেই শুনছে, নিচ্ছে….বিসমিল্লা একটা অদ্ভুত প্রতিভা এ যুগে, মানে ভাবতে পারা যায় না। তা ছাড়া ওই জিনিসটা, যেটা আমি বলতে চাই যে ভালবাসা, আছে।’
ফুঁ-এর কথা বলছেন রবিশঙ্কর। তো ‘বিসমিল্লা খান মানেই তো গান,’ বলছেন ওঁর সঙ্গে অজস্র যুগলবন্দির সাথি বিলায়েৎ খান। আশির দশকের মাঝামাঝি আনন্দবাজারের জন্য একটা সাক্ষাৎকার নিতে যেতে হয়েছিল এই প্রতিবেদককে। ওঁর সময়ের সেরা যন্ত্রীদের নাম করতে গিয়ে নাম নিলেন চার জনের। আলি আকবর, রবিশঙ্কর ও নিজের। এবং তালিকাটা শুরু করলেন বিসমিল্লা খান-কে দিয়ে।
কারণ? কী আজিব গান গাওয়া যন্ত্র ধরে। আজিব ফনকার (শিল্পী) বিসমিল্লা সাব।
রবিশঙ্কর কথিত ফুঁ, আর বিলায়েৎ খানের মতে গান গাওয়া এই দুই সত্যের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন বিসমিল্লা। ফুঁ তো বটেই, ওই গোল, ওজনদার, কাচের গুলির মতো মসৃণ আওয়াজের তো একটাই তুলনা গলা। কিন্তু গলারও অধম, মধ্যম, উত্তম আছে। তার পর আসে কোনও গায়কিতে সে গলাকে নিয়োগ করা। বিলায়েৎ খান বরাবরই নিজের বাদনকে গায়কি অঙ্গ সেতার বলেছেন। আর পিতৃদেব এনায়েৎ খান সাহেব সম্পর্কে একটাই প্রশস্তি করে দিয়েছেন সেতারের তানসেন।
সেই পিতৃদেবের নামাঙ্কিত পুরস্কার প্রথম দিলেন উস্তাদ বিসমিল্লা খান ও পণ্ডিত ভীমসেন জোশীকে। পরদিন বাড়িতে বসে বললেন, ‘আমি যন্ত্র দেখি না, দু’জনই গায়ক, দু’জনই গানকে এগিয়ে দিয়েছেন।’
বিষয় তো সেই প্রেম ও বিরহ, বসন্ত সমাগমে উল্লাস, অথবা বর্ষার অম্লমধুর প্রতীক্ষার ক্রমশ ব্যথায় পরিণত হওয়া, কিন্তু বিসমিল্লা ওই যে এক নিখুঁত, গোল ফুঁ-তে ধরলেন তা যেন সিদ্ধেশ্বরী দেবীর ‘আরে হাঁ’ বলে ঠুংরি ধরা। ওই ‘পোঁ’-তেই গোটা গানের মেজাজ কয়েদ হয়ে গেল। পরের দিকে পুকার ধ্বনির কথা ছেড়েই দিলাম, চৈতির ওই শুরুর ফুঁ তো গানের আকারধ্বনি। আর কী ব্যথা সেই ধ্বনিতরঙ্গে, যেন পূরব দেশের সমস্ত গ্রামীণ মানুষের মনের ব্যথা। আর এই চৈতি শেষ করেই অপর পিঠে যোগিয়া হয়ে ধরলেন তিলক কামোদের এক পুরোনো বন্দিশ। হায় হায়, মুহুর্মুহু যেন এক গায়ক ডেকে নিচ্ছেন আরেক গায়ক বিলায়েৎ খানের বাজানো তিলক কামোদকে। ক্রমান্বয়ে মনে আসছে ওঁদের আসরে বসে বাজানো তিলক কামোদ।
রবিশঙ্কর যে বলেছিলেন না ‘দেখো, বছরের পর বছর লোকটা যে বাজিয়ে যাচ্ছে’? তার একটা যুক্তির মোচড় আছে। যুক্তিটা এই: এত যে সুন্দর লাগে লোকটাকে শুনতে তা কি নিছক ভাললাগাতেই শেষ? যুগের পর যুগ ধরে আরও বেশি করে ভাললাগার কত যে রসদ জুটিয়ে গেলেন উস্তাদ তা দিনে দিনে লোকগাথার মতো হয়ে গেছে। তাঁর অসংখ্য রেকর্ড করা বাজনার মধ্যে কত কত রাগ যে বাজিয়ে গেলেন তা চট করে গুনে বলা যাবে না। শুধু বিসমিল্লার রেকর্ড বাজিয়ে অষ্টপ্রহরকে টুকরো টুকরো করে দেখা সম্ভব, এবং গভীর অনুরণনের সঙ্গে। যদিও ইদানীং বাঙালি আমোদীদের কাছে বিসমিল্লা মানে সন্ধে ও রাত, পুরিয়া, ইমন, শুদ্ধ কল্যাণ, কাফি, পিলু, বেহাগ, বাগেশ্রী তবু উস্তাদের তোড়ি, ভূপাল তোড়ি, গুণকেলি, আহির ভৈরব এবং অবশ্যই, ভৈরবী দিয়ে এক কালে ভোর হয়ে সকাল গড়াতে দেখা যেত বহু বাঙালি পরিবারে। অমুক কী তমুকের বাড়ি চেনানো হত এই বলে: ছ’টা বাড়ি পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ান, শুনবেন সানাই বাজছে। ওই বাড়িটাই।
গানকে কায়েম করার সঙ্গে সঙ্গে রাগকে কী ভাবে আদর করে জমানো যায় তার এক নির্ভুল নমুনা বিসমিল্লার তিন তালে বিস্তারিত বাগেশ্রী। যার করুণ মূর্ছনা কেনই জানি না ডেকে আনে আরেক করুণ মুহূর্ত, তবে ভোরের। ‘জলসাঘর’-এর নায়ক বিশ্বম্ভর রায় ভোরে ছাদে বসে আকাশের তারাদের মিলিয়ে যাওয়া দেখছেন। ওঁর প্রশান্তি বিঘ্নিত করল উঠতি বড়লোক গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে ভেসে আসা সানাইয়ের সুর। ও বাড়ির ছেলের উপনয়ন। আনন্দের সুরেই বাজছে বিসমিল্লার সানাই। কিন্তু একটু একটু করে ঘনিয়ে উঠছে রায় বাড়ির ট্র্যাজেডি।
ওঁর বাজনার মতো উস্তাদের জীবনও একটু একটু করে গভীর ও বিস্তারিত হয়েছে। যত ডাক বেড়েছে, ততই ধ্যান ও চর্চা বেড়েছে। মন্দিরের বালক সানাই বাদক শুধু একার ফুঁ ও প্রয়াসে সানাইকে দেশের জনপ্রিয়তম উচ্চাঙ্গ ধ্বনি করে তুলেছেন। সে সময়ও তো বরোদার খুব গুণী ও ভাল সানাই শিল্পী ছিলেন গণপত রাও। রবিশঙ্করের মতে তাঁর তান-টান, গমক এত সুন্দর যেত, রাগ-রাগিণীর কাজকর্মও অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ভারত জুড়ে যে সানাই গুঞ্জরিত হতে লাগল তার মহান কৃতিত্ব হিন্দি ছবি ‘গুঞ্জ্ উঠি শেহনাই-এর সঙ্গীত পরিচালক উস্তাদ বিসমিল্লা খান-এর।
তাঁর দীর্ঘ জীবনে স্বীকৃতি পাওয়াটাও তাঁর প্রিয় যন্ত্রটির (সানাইকে উস্তাদ বলতেন তাঁর বেগম) স্বীকৃতি পাওয়ার মতোই ধাপে ধাপে। সদ্য যৌবনে, ১৯৩০-এ, ইলাহাবাদ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সেরার পুরস্কার পেলেন। ১৯৩৭-এ ওই সম্মেলনেই পর পর তিনটি পদক পেলেন। প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বাজানোর চোদ্দো বছর পর ১৯৬১-তে পেলেন পদ্মশ্রী। ১৯৬৮-তে পদ্মভূষণ। এবং ২০০৬-এ মৃত্যুর কিছু কাল আগে ভারতরত্ন। তাঁর মৃত্যুর দিনটিকে ২১ অগস্ট, ২০০৬ ভারত সরকার জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করেছিলেন। একুশটি গান স্যালিউটের সঙ্গে ওঁর মরদেহকে কবর দেওয়া হয় পুরোনো বারাণসীর ফতেমাইন গোরস্থানে একটি নিম গাছের নীচে। কবরে ওঁর সঙ্গী হয় ওঁর প্রিয় একটি সানাই। যাদের বেগম বলে ডাকতেন তাদের একটি।
শহর কলকাতা উস্তাদের অগণিত সেরা অনুষ্ঠানের সাক্ষী। যার একটি সত্তর দশকে কলামন্দিরে রেডিয়ো সঙ্গীত সম্মেলনের অনুষ্ঠান। বাজিয়েছিলেন বেহাগ। খেয়াল অঙ্গের বাজনায় সেদিন কিছু তান করেছিলেন, যা ভোলার নয়। রেডিয়োর সংগ্রহশালায় যদি সে বাজনা থেকে থাকে তবে এই এক শত এক পূর্তিতে তা বাজানোর স্বর্ণিল সময় এল।
কলকাতা সাক্ষী বিসমিল্লা-বিলায়েতের এক ঐতিহাসিক যুগলবন্দির, ১৯৭৭-এর শেষ বসন্তে, নেতাজি ইন্ডোরে। উস্তাদরা বাজিয়েছিলেন ইমন, বেহাগ, খাম্বাজ। বার কয়েক সেদিন বিলায়েৎ খান নানা বন্দিশ গেয়ে দিয়েছিলেন, এবং সেই সুরের জবাবে বিসমিল্লা খান যেভাবে সুরে বাড়ছিলেন তা বোঝানোর একমাত্র উপায় সেই সন্ধ্যার টেপটা বাজানো।
যে রকম একটা টেপ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল সেতারশিল্পী সুব্রত রায়চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে। সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনের অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়ে সুব্রতর একটা দাবি ছিল সংগঠনের কর্তার কাছে: কনফারেন্সে বিসমিল্লা-বিলায়েতের ডুয়েটের একটা টেপ আমার চাই। তাতে মিশ্র গারাতে যে ঠুংরিটি ওঁরা বাজিয়েছিলেন (‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির ‘মোহে পনঘটপে নন্দলালা ছোড় গয়া রে’ গান হিসেবে যা মানুষের ঠোঁটে ঠোঁটে) তা সন্ধের পর সন্ধে শুনে শুনেও আমরা ক্লান্ত হতে পারিনি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে নিখুঁত এবং মহত্তম এক নজির হিসেবে বাজনাটাকে গণ্য করা যায়। লং প্লে-তে রেকর্ড করা উস্তাদদের যুগলবন্দি যার ছায়ামাত্র উস্তাদের জন্মদিনে সেটিকে বাণিজ্যিক ভাবে প্রকাশ করা গেলে বড় কাজ হয়।
বড় কাজ হবে মৃত্যুর কিছুকাল আগে নতুন দিল্লিতে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কংগ্রেসের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উস্তাদের যে আসর হল পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে সেটিকে সিডি করে বাজারে আনতে পারলে। হায়! হায়! কী বাজনা! দূরদর্শনের লাইভ টেলিকাস্টে নব্বইয়ের কোঠার দুই শিল্পীর ওই যুগলবন্দি শুনতে শুনতে অনেকেরই চোখে জল এসেছে, খেয়াল হয়েছে আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। দশ বছরের মধ্যে একে একে চলে গেলেন বিলায়েৎ খান, বিসমিল্লা খান, আলি আকবর খান এবং রবিশঙ্কর।
এই চার মহাপুরুষের মধ্যে সর্বাগ্রে শতবর্ষ পেরিয়েছেন তিনিই। শেহনাই নওয়াজ উস্তাদ বিসমিল্লা খান সাহেব। ওঁর অমৃত ফুঁ-তে ধরা সানাই সুর আরও বহু বহু কাল ধরে বাজবে।
ওঁরই এক স্মৃতিচারণা দিয়েই শেষ করি। উস্তাদকে নিয়ে এক তথ্যচিত্র গড়তে গিয়ে ওঁর মুখের এই কথা রেকর্ড করেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ত্ব অসিত বসু ও ভদ্রা বসু। উস্তাদ বলছেন, “উস্তাদ আব্দুল করিম খানের সঙ্গে এক কনফারেন্সে দেখা। কথা হচ্ছিল শরীর-স্বাস্থ্য, এটা-ওটা। তারপর তো করিম খান গাইতে চলে গেলেন। আমার কেনই জানি না মনে হল, উনি আজ তোড়ি গাইবেন।”
অসিত, ভদ্রা জানতে চাইলেন, “কেন মনে হল?”
উস্তাদ বললেন, “ওঁর চোখ দেখে। ওঁর চোখ বলে দিচ্ছিল ওঁর মধ্যে তোড়ি আসছে।”
ঘটনা হল, সেদিন উনি আসরে বসে তোড়িই ধরে নিলেন। তাতে কম আশ্চর্যান্বিত হননি স্বয়ং বিসমিল্লা খানও। যদিও ওর নিজের ভিতর থেকেই ইশরা এসেছিল অমর উস্তাদ তোড়ি শোনাবেন। এর কিছু দিন পরই কিরানা শিরোমণি করিম খান সাহেব দেহরক্ষা করলেন। আর তাঁর স্মরণে আসরে বসে বিসমিল্লা খান ধরে নিলেন সেই রাগ তোড়ি। কেন তোড়ি, সেটার পটভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে মরহুম (প্রয়াত) উস্তাদের গাওয়া তোড়ির কথা বললেন।
তার পর যেই সানাইতে তোড়ির রেখাব লাগিয়েছেন, অমনি হায় হায় করে উঠলেন সমস্ত শ্রোতা। বললেন, “কে বলেছে করিম খান নেই? এই তো আমরা তাঁকেই শুনছি।”
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছিল অনেক দিন।
আলাপ
• বিসমিল্লা খান ছাত্র গড়তে চাইতেন না। বলতেন, কতটুকুই বা শেখাতে পারি? আর তার কতটুকুই বা ওরা কাজে আনতে পারবে? তার চেয়ে রেওয়াজ করে করে আওয়াজ তৈরি করুক আর আমাকে শুনে যাক।
• খান সাহেবের জনক-জননী ছিলেন পয়গম্বর খান ও মিঠ্ঠন। ওঁর ঠাকুরদা ছিলেন সানাই-উস্তাদ রসুল বখ্ত খান। তবে শিক্ষা কাকা আলী বখত বিলায়াতু’-র কাছে। জন্মের পর খান সাহেবের নাম হয়েছিল কামারুদ্দিন খান।
• খান সাহেবের প্রিয় পোশাক ছিল শেরওয়ানি আর মাথায় টুপি। নেশা ছিল ধুমপান।
• খান সাহেবের রেকর্ড করা বাজনার সংখ্যা বিরাট। ক্লাসিক্যাল এল পি বাজে অথচ বিসমিল্লা বাজেন না, এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ওঁর বর্ণনায় একটা শব্দ সারাক্ষণ ঘুরে ফিরে আসে ‘উইজার্ড’ অর্থাৎ জাদুকর।
আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে।
……………….
আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে।
তথ্য সংগৃহীত – প্রতাপ সাহা। ধন্যবাদ।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,