ছাত্রজনতার বঙ্গবন্ধু থেকে গণমানুষের মুক্তির মহানায়ক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা থেকে এক স্বাধীন জাতির জনক। ৫১ বছর বয়সে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর ৫৫ বছর বয়সে বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ডে জীবনাবসান। উত্তাল এই জীবনের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর জন্মদিন।
আজ থেকে এক শ বছর আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিক ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এমন এক মার্চে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সে ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে নিয়ে আসে স্বপ্নের স্বাধীনতা। এর জন্য মানুষকে তিলে তিলে তৈরি করেছেন তিনি। নিজেও তিলে তিলে সয়েছেন শত যন্ত্রণা। জীবনের ১৪টি বছর কাটিয়েছেন কারাগারে।
স্মরণ আর উৎসবে দেশ আজ তার মুক্তির মহানায়ককে সামনে নিয়ে এসেছে। গত বছর এই দিনটি ছিল তাঁর শততম জন্মদিন। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পুরো বছর মুজিব বর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত বছর সূচি অনুযায়ী মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করা যায়নি। এবার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করছে বাংলাদেশ। এই বছর তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি আরও বিশেষভাবে ধরা দিয়েছে। তাই শতবর্ষী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০ দিনের অনুষ্ঠান ‘মুজিব চিরন্তন’ শুরু হচ্ছে আজ বুধবার।
বিশ্বনেতারা সশরীর আর ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ইতিহাসের এই মহাপুরুষকে ভালোবাসা জানাবেন। সেই সঙ্গে তাঁরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এ মহানায়কের অমর কীর্তির কথা স্মরণ করবেন। বিশ্বনেতারা মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পাঁচ দশকের অর্জন আর সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়েও কথা বলবেন।
বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ১০ দিনের এই উৎসবে ঢাকায় সশরীর হাজির হচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং।
এ ছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং স্যু-কুয়েন, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন, ওআইসির মহাসচিব ইউসেফ আহমেদ আল-ওথাইমিন এবং পোপ ফ্রান্সিস ভার্চ্যুয়ালি মুজিব চিরন্তনের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। দেবেন ভিডিও বার্তা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলছেন, এটা কোভিড সংক্রমণের এক অস্বাভাবিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের গভীরতা আর আস্থার বহিঃপ্রকাশ।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ১০ দিনের এই অনুষ্ঠানে প্রতিদিন থিমভিত্তিক নানা আয়োজন থাকছে। এগুলোর মধ্যে পাঁচ দিন দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতারা বিশেষ অতিথি হয়ে বক্তৃতা দেবেন। বক্তৃতা করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বাকি পাঁচ দিন ভিডিও বক্তৃতা দেবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান নির্বাহীরা। প্রতিদিন থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১০ দিনের এই অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে মৈত্রী রাগ পরিবেশন করবেন ভারতীয় শিল্পীরা। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিতসংখ্যক আমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানগুলো আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিদিনের অনুষ্ঠান ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা ভারতের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী মমতা শংকর ও তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষ নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশের সঙ্গে, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এগিয়ে নিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানান এই শিল্পী দম্পতি।
গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলেছে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে কীভাবে তুলে ধরা হবে, জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান নূর সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ জীবনসংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহসিকতায় আপসহীন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসব খুঁটিনাটি তথ্য তুলে ধরা হবে এসব অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের আত্মত্যাগের বিষয়টিও দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, উন্নয়নের দিকে গিয়েছে তা–ও থাকবে এখানে।
আজ বুধবার বিকেল সাড়ে চারটায় ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়’ থিমে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ স্বশরীরে উপস্থিত থাকবেন। শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হবে অনুষ্ঠান। মুজিব চিরন্তন থিমের ওপর একটি এনিমেশন চিত্র প্রদর্শিত হবে। থিম সংয়ের মিউজিক ভিডিও প্রদর্শিত হবে। স্বাগত ভাষণ রাখবেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
আজ ভিডিও বার্তা দেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো। এর বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেবেন ইব্রাহিম সলিহ। পরে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। অতিথিদের কাছে স্মারক হস্তান্তর করা হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্ধ্যা ছয়টার পর বাংলাদেশ এবং ভারতীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৭ মার্চকে ঘিরে রাজধানীর বড় ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। বর্ণিল আয়োজন অব্যাহত থাকবে ২৬ মাচৃ পর্যন্ত। সড়কের দু’পাশ ও মোড়ে মোড়ে শোভা পাচ্ছে বাহারি রংয়ের আলোর ঝলকানি।
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আগত অতিথিরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর পাঁচ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
আ.লীগের কর্মসূচি
দিবসটি উপলক্ষে ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে সংগঠনের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
বেলা সাড়ে তিনটায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’ আয়োজিত কর্মসূচিতে আমন্ত্রিত নেতারা অংশগ্রহণ করবেন।
দেশব্যাপী মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ সারা দেশে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আলাদা কর্মসূচি থাকছে। সকাল ১০টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রতিনিধিদল জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে। তারা দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশ নেবে।
২১ মার্চ রোববার বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ১৭, ২০২১,
রেটিং করুনঃ ,