লেখক: মাসুদ মিলাদ
এক দশক আগেও দেশে বিলিয়ন ডলার বা শতকোটি মার্কিন ডলার খরচ করে আনা আমদানি পণ্য ছিল তিনটি। বছর ঘুরতেই এখন এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। তাতে গত অর্থবছর শেষে এই তালিকায় আমদানি পণ্যের সংখ্যা বেড়ে ১০টিতে উন্নীত হয়েছে। যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও চার–পাঁচটি।
এই ১০ পণ্যের বেশির ভাগই শিল্পের কাঁচামাল। এক দশক আগে তালিকায় ছিল তুলা, ডিজেল ও পুরোনো জাহাজ। এক দশকের ব্যবধানে এই তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার, ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও পুরোনো জাহাজ, প্রাণিখাদ্যশিল্পের কাঁচামাল সয়াবিন বীজ, খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের কাঁচামাল গম ও অশোধিত পামতেল। এ ছাড়া রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল।
তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা। এর বাইরে রয়েছে সিমেন্ট, ইস্পাত ও কৃষিপণ্য খাতের কাঁচামাল। এই তিন খাতের ছয়টি কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য মূলত দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। আবার এসব কাঁচামাল দিয়ে তৈরি সিমেন্ট, রড, সয়া কেক ও বিস্কুট কমবেশি রপ্তানি হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যন্ত্রের চাকা ঘুরতে জ্বালানি ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। তাতে ডিজেলের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলের আমদানি বেড়ে শতকোটি ডলারের ক্লাবে যুক্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বিলিয়ন ডলারের আমদানি পণ্যের সিংহভাগই শিল্পের প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ায় যেমন গম ও পামতেলের মতো আমদানি পণ্য বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, আবার সরকারি অবকাঠামো খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের ফলে অবকাঠামো শিল্পের প্রসার হয়েছে। এতে সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের কাঁচামাল আমদানি বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও বিপণনে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
এই তালিকায় রপ্তানি খাতের কাঁচামালের সংখ্যা কম থাকা দুঃখজনক উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে প্রমাণ হয় বাংলাদেশে এখনো শিল্পায়ন প্রাথমিক পর্যায়ে আটকে আছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানি বাড়লে শিল্পায়নেও অগ্রগতি হবে। আবার প্রচলিত জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পণ্যের সরঞ্জাম এই তালিকায় থাকলে পরিবেশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।
এক বিলিয়ন ডলারে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৪ টাকা ধরে)। বিলিয়ন ডলারের পণ্যের তালিকায় আমদানি পণ্যের হিসাব করার ক্ষেত্রে একক পণ্য বিবেচনা করা হয়েছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি, সুতা, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক—খাত হিসেবে বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বহু আগেই। তবে একক পণ্যের তালিকায় নেই কোনোটি।
তুলা
এক দশকের বেশি সময় ধরে আমদানি ব্যয়ে এককভাবে শীর্ষে রয়েছে কাঁচা তুলা। তুলা থেকে সুতা এবং সুতা থেকে কাপড় তৈরি করে রপ্তানিমুখী শিল্প এবং দেশীয় শিল্পের চাহিদার জোগান দেওয়া হচ্ছে। দেশীয় বস্ত্র খাত এবং রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের প্রসার হওয়ায় তুলা আমদানি বাড়ছে। এই কাঁচামালের আমদানি বর্তমানে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
পুরোনো লোহা
রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল এখন পুরোনো লোহা। একসময় মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট আমদানি করে রড তৈরি হতো। এখন প্রাথমিক কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা দিয়ে রড তৈরি হচ্ছে। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে প্রথম শতকোটি ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে এই কাঁচামাল। দেশে চাহিদা যত বাড়ছে, ততই আমদানি বাড়ছে এই পণ্যের। গত অর্থবছরে ১৩১ কোটি ডলারে আমদানি হয়েছে ৩৭ লাখ টন পুরোনো লোহা।
পুরোনো জাহাজ
সনাতন ও আধা স্বয়ংক্রিয় কারখানার যুগে পুরোনো জাহাজই ছিল রড তৈরির প্রধান কাঁচামালের উৎস। এখন এই শিল্পের কাঁচামালের দ্বিতীয় প্রধান উৎস পুরোনো জাহাজ। ২০১১–১২ অর্থবছরে বিশ্বে পুরোনো জাহাজের দাম বেড়ে যাওয়ায় শতকোটি ডলারের পথ পাড়ি দেয় এই পণ্য। এক বছর বিরতি দিয়ে গত অর্থবছরে ১০২ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে এই পণ্য আমদানিতে।
ক্লিংকার
সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচটি কাঁচামাল আমদানি হয়। এই পাঁচটির মধ্যে প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারই গত অর্থবছরে প্রথমবার জায়গা করে নিয়েছে শতকোটি ডলারের আমদানি পণ্যের ক্লাবে। আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ টন। পরিমাণের হিসাবে আমদানির তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে ক্লিংকার।
সয়াবিন বীজ
সয়াবিন মাড়াই করে মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্যখাদ্য তৈরি করা হয়। আবার সয়াবিন তেলও পাওয়া যায়। গত বছর সিটি ও মেঘনা গ্রুপের সয়াবিন মাড়াইয়ের দুটি নতুন বড় কারখানা চালু হওয়ায় সয়াবিন আমদানি বেড়ে শতকোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুরে গত বছর ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণিখাদ্য, আটা–ময়দা ও তেলের সমন্বিত কারখানা স্থাপন করেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ না পাওয়ায় এ কারখানা এখনো চালু হয়নি। এটি চালু হলে আমদানি আরও বাড়বে। তাতে দরকার হবে না সয়া কেক আমদানি। সয়াবিন তেল আমদানির ওপরও নির্ভরতা কমবে।
গম
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে দেশে গমের চাহিদা বাড়ছিল কয়েক বছর ধরে। চাহিদার মাত্র ১০–১২ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। তাতে প্রতিবছর এই কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়ছে। ছয় বছর আগে শতকোটি ডলার আমদানি পণ্যের খাতায় নাম ওঠে গমের। গমের তৈরি খাদ্যপণ্য দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। আবার রপ্তানিও হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৬৭ লাখ টন গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৮৮ কোটি ডলার।
পামতেল
প্রধান দুই ভোজ্যতেল সয়াবিন ও পাম তেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পাম তেল। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে এই পণ্য আমদানি শতকোটি ডলার ছাড়ায়। পাম তেলের বহুমুখী ব্যবহারই এটিকে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে নিয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস
আমদানির তালিকায় সবচেয়ে নবীন পণ্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি। আমদানি শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে। পরপর দুই অর্থবছর ধরে এটি আমদানিতে ব্যয় ছাড়িয়েছে দেড় শ কোটি ডলারের বেশি।
ডিজেল
গাড়ির চাকা আর সেচপাম্পের মোটর ঘোরে ডিজেলে। এই পেট্রোলিয়াম পণ্য এক দশক আগেই বিলিয়ন ডলার ক্লাবে যুক্ত হয়েছে। তবে জ্বালানি ব্যবহারে পরিবর্তন আসায় ডিজেল আমদানি কমছে। পরিবহন ও সেচে ডিজেলের ব্যবহার কমে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রেও ডিজেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ফার্নেস অয়েল। তারপরও পণ্যটি আমদানিতে এখনো বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়।
ফার্নেস অয়েল
ডিজেলের তুলনায় খরচ কম হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি হচ্ছে ফার্নেস অয়েল। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা ফার্নেস অয়েল আমদানি করছে। গত অর্থবছরে পণ্যটি প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে বিলিয়ন ডলারের আমদানি পণ্যের তালিকায়।
এই ১০টি ছাড়াও বিলিয়ন ডলার আমদানি পণ্যের পথ পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও কয়েকটি পণ্য। এলপিজির চাহিদা বাড়ায় পণ্যটির উপাদান বিউটেন কয়েক বছরের মধ্যে বিলিয়ন ডলার ক্লাবে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভোগ্যপণ্য অশোধিত সয়াবিন তেল ও চিনিও এই তালিকার খুব কাছেই। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কল্যাণে শিগগিরই যুক্ত হতে পারে কয়লা।
তালিকায় থাকা একাধিক পণ্যের আমদানিকারক প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও সীকম গ্রুপ। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিলিয়ন ডলারে প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি পণ্যের সংখ্যা বাড়ার অর্থ হলো অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে। প্রক্রিয়াজাত কারখানা বাড়ছে। এখনই দেশের বাজারে চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি হচ্ছে। তাতে আমদানি–নির্ভরতা কমছে। এভাবেই শিল্পায়নে প্রসার হবে।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ০২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,