কিছুক্ষন আগেই শেষ হয়েছে সমুদ্র দেবের আরতি। সূর্যের শেষ আলোটুক মিশে গেছে জলে। আঁধার নেমেছে রোজকার নিয়মে। তবু এরই মাঝে থেকে থেকে ঝলসে উঠছে রুপোলী ঢেউয়ের মুকুট। প্রবল বিক্রমে ছুটে এসে আছড়ে পরছে পাড়ে। রাস্তার ধার ঘেঁষে বালুতটে সেজে উঠেছে মনোহারি দোকান। মিটমিটিয়ে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। যেন কত তারা রাতের আকাশে।
সারি সারি দোকানের মাঝে খদ্দেরদের আনাগোনা। তাদের সব কলরব ছাপিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। সামনে অসীম সমুদ্র অর্ধ বৃত্তাকারে মিশেছে আকাশের প্রান্তে ঘন কালো রেখায়। যত দূর চোখ যায় কেবল জল আর জল। এই অসীম বিস্ময়ের সাথে একাত্ম হতে চায় মন। সাদায় কালোয় জীবনের ছবিটা স্পষ্ট ধরা পরে এখানে। ঘন কালো জলের মতো একরাশ দুঃখ আর থেকে থেকে ঝলসে ওঠা দুধসাদা ফেনিল খুশির উচ্ছাস এই দুয়ের মিল মিশেই জীবন।
সম্বিৎ ফেরে শাঁখের আওয়াজে।নানা ধরণের আওয়াজ ভেসে আসছে ওই দোকানগুলো থেকে। এবারে ফিরতে হবে আস্তানায়। আঁধার নামলে পুরীর সমুদ্রের রূপ যায় বদলে। অনন্ত বিস্তার নিয়ে সেও যেন জগন্নাথ দেবের মতো দু বাহু বাড়ায়ে ডাকে। এই অমোঘ আহ্বান এড়িয়ে যাবার সাধ্য বা সাধ কোনোটাই নেই আমার। পোশাকের নিচে লেগে থাকা নোনা বালিটুকু সম্বল করে এগোই। দোকান গুলো পেরিয়েই রাস্তায় উঠতে হবে। চলতে চলতে চোখে পরে দুপাশের ডালায় সাজানো সব রকমারি শঙ্খ। কি অপূর্ব তাদের কারুকাজ! খদ্দেররা দরদস্তুর করছেন। আর বিক্রেতারাও তাদের আকর্ষণ করতে একটার পর একটা বাজিয়ে চলেছেন। এ সবই তো সমুদ্রের দান। জীবনের তাগিদে জীবনের বেসাতি। একবার ইচ্ছে হয়েছিল জিজ্ঞেস করি, “পাঞ্চজন্য দেখাতে পারেন”! তবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে সাধ সম্বরন করতে হল । প্রায় নটা বাজে তাই আর না দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলি। কিন্তু শঙ্খ গুলো ততক্ষনে আমার পিছু নিয়েছে। কেবল মনে হতে লাগলো কে জানে ওই শঙ্খ গুলোর মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে জ্যেষ্ঠ পান্ডবের অনন্তবিজয় কিংবা দ্বিতীয় পান্ডবের পৌন্ড্র। এমনও হতে পারে, পান্ডব কূলতীলক অর্জুনের দেবদত্ত শঙ্খ রয়েছে ওদের ডালায়। কিংবা খুঁজলেই মিলে যাবে সহদেব ও নকুলের সযত্নে রক্ষিত শঙ্খ মণিপুস্পক ও সুঘোষ। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে এই শঙ্খগুলোই বাজিয়েছিলেন পঞ্চ পান্ডব।
কৌরব পক্ষের মহা পরাক্রমশালী যোদ্ধারাও বাজিয়েছিলেন নিজ নিজ শঙ্খ । কৌরবদের কর্ণধার, বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের মনে সাহস ও উৎসাহ যোগাতে শুরুতেই সিংহ বিক্রমে বাজিয়েছিলেন তাঁর শঙ্খ তবু সে আওয়াজ কোথায় যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল পান্ডবদের শঙ্খের কাছে।
আর পাঞ্চজন্য ! যা কিনা বাজিয়েছিলেন মহাভারতের নায়ক তথা পার্থসারথী স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ, যাকে ঘিরে এত ঘটনা তাকেও কি খুঁজলেই মিলবে ওই দোকানে!
এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পরে গেল পাঞ্চজন্য কে ঘিরে ছেলেবেলায় শোনা পুরানের গল্প। শঙ্খাসুর নামে এক অতিকায় দানব বাস করতো প্রভাস সাগরের নিচে। সে থাকতো এক শঙ্খের ভেতর। প্রবল পরাক্রমশালী এই দানবের সাথে যুদ্ধে কেউ এঁটে উঠতে পারছিলনা। এই শঙ্খাসুর একদিন সন্দীপন মুনির পুত্রকে অপহরণ করে বন্দি করলো ওই প্রভাস সাগরের তলদেশে।
এদিকে মহর্ষিগর্গের কাছে যাওয়ার আগে কৃষ্ণ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরামের সঙ্গে পড়তে গিয়েছিলেন সন্দীপন মুনির পাঠশালায়। পড়া শেষ হলে বিদায় বেলায় কৃষ্ণ গুরু দক্ষিনা দিতে চাইলে সন্দীপন মুনি তার পুত্রকে শঙ্খাসুরের কবল থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনতে বললেন । তখন কৃষ্ণ ও বলরাম প্রভাস গেলেন এবং সেখানে শঙ্খাসুরকে দমন করলেন। কিন্তু গুরুপুত্রকে সেখানে পেলেন না। তখন কৃষ্ণ বুঝতে পারেন, গুরুপুত্রকে শঙ্খাসুর হত্যা করেছে। তাই তিঁনি যমলোকে গমন করেন সেই শাঁখটিকে সঙ্গে নিয়ে। যমলোকের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি সেই শাঁখে ফুঁ দেন। শঙ্খধ্বনি শুনে স্বয়ং যম বেরিয়ে আসেন এবং তিনি শ্রীবিষ্ণুর অবতারকে চিনতে পারেন। কৃষ্ণ যমের কাছে থেকে গুরুপুত্রের জীবন ভিক্ষা চান। যম তাঁর আর্জি মঞ্জুর করেন। জীবিত গুরুপুত্রকে নিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম মর্ত্যে ফিরে আসেন এবং সন্দীপন মুনিকে তার পুত্র ফেরত দিয়ে গুরু দক্ষিণা দেন। আর শঙ্খাসুরের সেই শঙ্খই ‘পাঞ্চজন্য’ নামে খ্যাত হয়। পাঞ্চজন্য তো শুধু শঙ্খ নয় এ হলো অশুভের ওপর শুভর বিজয় নাদ। এর আওয়াজে সব বাঁধা বিঘ্ন যায় কেটে। শঙ্খের কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় এসেই পড়েছি হোটেলের দোরগোড়ায়।
এ শঙ্খ গুলোর সাথে মনে মনে আমার নিত্য যোগাযোগ। আসলে মনের মাঝে যে কুরুক্ষেত্র ময়দান সেথায় আজও লড়াই অবিরত। ‘ভালো আমি’ আর ‘মন্দ আমি’-র লড়াই। কখনো বা চেনা আমি আর অচেনা আমি মুখোমুখি। আর তখন তৃতীয় আমি প্রানপনে খুঁজে চলে পাঞ্চজন্য কিংবা অনন্তবিজয়, পৌন্ড্র নয় দেবদত্ত, নিদেনপক্ষে সুঘোষ অথবা মণিপুস্পক। একটা বিজয় শঙ্খ বাজিয়ে দিতে পারলেই সব অশুভর বিনাশ ঘটিয়ে শুভ আমি-র জয় নিশ্চিত।
লেখক: সুনীতা দাস।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: জুন ০৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,