আমার কাছে মনে হয় সম্পর্ক হ্যন্ডেল করা জটিল একটি বিষয়। একে কেউ চাইলে এক নিমিষে উড়িয়ে দিতে পারে আবার কেউ সম্পর্কের জটিল অলি গলি পার হয়ে একে টিকিয়ে রাখতেও পারে। সুখী হওয়া এবং দুঃখী হওয়াটা একেক জনের কাছে একেক রকম। এজন্যই লিও তলস্তয় তার “এনা ক্যারেনিনা” বইয়ের শুরুতেই বলেছেন, “Happy families are all alike; every unhappy family is unhappy in its own way.”
এই এপিক বই পড়ে শেষ করলাম।পূর্বে কয়েকবার এই বই ধরেও ছেড়ে দিয়েছিলাম সময়ের অভাবে । কিন্তু এবারে লক্ষ্য স্থির করে, সময়নাশাক উপাদান গুলো সীমিত করে বই শেষ করলাম। যদিও কিছু কিছু অংশ চোখ বুলিয়ে সারসংক্ষেপ করেও পড়েছি। তবে বেশী কিছু মিস হয়নি। এই বই চোখ বুলিয়ে পড়া উচিৎ নয়, কারণ প্রতিটি লাইনে নিহিত রয়েছে সাহিত্য ও দর্শনের প্রজ্বলিত উদাহরণ। একটা লাইন মিস হয়ে যাওয়া মানে অনেক কিছু মিস হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের জীবন তো যন্ত্রের মত দৌড়ায়, আমাদের এতো সময় কোথায়! তবুও এই বইয়ের জন্য সময় ব্যয় করলে সময় বিফল হয় না। আমি Wordswarth Classics এর ইংরেজি ট্রান্সলেশন পড়েছি। যেহেতু রাশিয়ান বুঝি না। অসাধারণ ট্রান্সলেশন।
প্রাচুর্যময় সম্ভ্রান্ত সমাজের পটভূমিতে কিছু সম্পর্ক, অসম্পর্ক অর্থাৎ জীবন নিয়ে লেখা এই গল্পের সম্মোহন এতোটাই শক্তিশালী যে পাঠক মুগ্ধ হয়ে এর সাহিত্য রস উপভোগ করে । আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
“এনা ক্যারেনিনা” লিও তলস্তয়ের এক অসামান্য সৃষ্টি। এনা যেন জীবন্ত কেউ।কাল্পনিক এনা চরিত্রে লেখক এমন জীবন দান করেছেন যে এনা যুগ যুগ বেঁচে থাকবে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। কতটুকু গাঢ় কল্পনা শক্তি থাকলে এরকম অনবদ্য চরিত্রের জন্ম হয় সেটা ভাবতেও অনেক গভীর কল্পনা শক্তি লাগে। বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছিলো আমি সময় যন্ত্রে চেপে উল্টো দিকে অতীতের রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। এখনো ঘোর কাটেনি।
বইটির নাটকীয়তা আমার খুব ভালো লেগেছে। শেক্সপিয়রিয়ান ড্রামা হচ্ছে মেলো ড্রামায় ভরপুর যেটা হয়তো একটু বেশী বেশী মনে হতে পারে আমাদের এই নব্য যুগে।কারণ তিনি লিখতেন স্টেইজ পারফর্মেন্সের জন্য যেখানে শব্দে, কাহিনীতে সুরের তরঙ্গ আবশ্যক ছিল।সুরে সুরে অনুভূতিকে ইঞ্জেক্ট করা হতো অডিয়েন্সের মাঝে । তলস্তয়ের লেখায় শুধুই ড্রামা রয়েছে। সাহিত্যে ড্রামা/ নাটকীয়তা না থাকলে সাহিত্য রস উপভোগ করা যায় না।অনুভূতিকে হৃদয়ঙ্গম করা যায় না।
এনা এমনই একজন নারী যার শুধুই বাহ্যিক রূপ রয়েছে তা নয়। তার আত্মাটিও দারুন রূপসী অর্থাৎ সে ভিতরেও চমৎকার একজন মানুষ । সেই আত্মাটিই হয়তো বাহ্যিক রূপকে অতুলনীয় করে তোলে। রূপ গুণ সবই রয়েছে তার যেটা আকৃষ্ট করে যে কোন পুরুষকে। তার রূপের চেয়েও তার সাথে কথা বলার পরে যে কেউ মুগ্ধতায় ভেসে যায়। কিন্তু প্রায় কুঁড়ি বছরের মত বয়সে বড় স্বামীর সাথে তার কোন কিছুতেই মিল নেই। শুধুমাত্র স্বামী স্ত্রীর কর্তব্য পালনে সমাপ্ত হতো তাদের প্রতিটি দিন। তাই সত্যিকারের ভালোবাসাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে ভালোবাসার দুঃখ সাগরে ঝাঁপ দিতে সে দ্বিধা বোধ করেনি। সে তার স্বামীর অগচরে কিছু করেনি। সে ছিল সাহসী নারী। সে তার সুখ শান্তির ছাপোষা জীবন ত্যাগ করে প্রকৃত ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পণ করে, যেটা তার জীবনের কঠিন পরিণতির জন্য দায়ী হয় পরবর্তীতে।
বেশী কিছু লিখলাম না, কারণ বই স্পইল করা আমার পছন্দ নয়। যদি আরও বেশী লিখি সেটা বই এনালাইসিস হয়ে যাবে। যেটা লেখা অনেক পরিশ্রমের কাজ।পরিশ্রম বীণা পয়সায় ফেসবুকের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে আমি রাজি না।
এই বইটি অবশ্যই পড়া উচিৎ যারা সাহিত্য চর্চা করেন। আর ফেসবুক স্ট্যাটাস টাইপ সাহিত্য জগতের মানুষের কাছে এ বই বোরিং লাগতে পারে।
সংগ্রহিতঃ
লেখিকা: গুলশান কিবরিয়া (ফেবু)
তারিখঃ জুলাই ০৮, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,