লর্ড ক্যানিং ও তাঁর বাড়ির গল্প –
লর্ড ক্যানিং 1856 থেকে 1862 সাল পর্যন্ত ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল এবং 1858 সালের 1 নভেম্বর থেকে ভারতে প্রথম ভাইসরয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর প্রশাসনের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো 1857 সালের সিপাহি বিদ্রোহের সূত্রপাত। লর্ড ক্যানিং বিদ্রোহটি দমন করেন এবং এ ঘটনার পর 1858 সালে পার্লামেন্টারি আইন পাস হয়। রানী ভিক্টোরিয়া প্রকাশ্য ঘোষণা দ্বারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। যারা এ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তাদেরকে যদিও তিনি (ক্যানিং) শাস্তি প্রদান করেন, তবুও তিনি যতদূর সম্ভব ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বাছবিচারহীন প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ পরিহার করেন, এবং এভাবে তিনি ‘ক্ষমাশীল ক্যানিং’ এর উপাধি অর্জন করেন।
1856 থেকে 1862 এই সময়কালের প্রথম দু’বছর ভারতের গভর্নর-জেনারেল এবং পরের চার বছর ভাইসরয় ছিলেন চার্লস জোহান আর্ল ক্যানিং, তা আগেই উল্লেখ করেছি। পরবর্তীতে তিনি লর্ড উপাধি গ্রহণ করেন। এই সময়ই তৈরি হয় পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি। সেই কোম্পানি মাতলা নদীর ধারে তৈরি করে স্ট্যান্ড, হোটেল ও কিছু বাড়ি। কিন্তু 1867 সাল নাগাদ নদীর পথ পরিবর্তনের সে সব ভেঙে যায়। আজ কথা বলবো তেমনই এক বাড়ি নিয়ে, যার সাথে আজও ক্যানিংয়ের নাম জুড়ে। কিন্তু তা আর কতদিন; সেটাই এখন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন, কারণ এই বাড়িটিও মাটিতে মিশে যেতে চলেছ। আজ সেই বাড়ির গল্প জানা যাক।
ক্যানিং মহকুমার মূল স্থান ক্যানিং একটি সুপ্রাচীন জনপদ যা গড়ে উঠেছিল বড়লাট লর্ড ক্যানিং এর নামানুসারে। মাতলা নদীর তীরে এই জায়গাটি বর্তমানে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত। ভারতবর্ষের তৃতীয় শহর হিসেবে ক্যানিং এ রেলপথ স্থাপন হয় তৎকালীন ক্যানিং বন্দরের সুবিধার্থে 1862-63 সালে। উল্লেখ্য এ রাজ্যের ইতিহাসে ক্যানিংই ছিল প্রথম পুরশহর। পরে সেই তকমা মুছে যায়। স্বাধীনতার পরে মহকুমা শহর হিসাবে গড়ে উঠলেও পুরসভার তকমা এখনও ফিরে পায়নি এই শহর। লর্ড ক্যানিং এর একটি বাড়ি ক্যানিং শহরে এখনও বর্তমান। এই বাড়িটি সে যুগের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
লেডি ক্যানিং যখন আসতেন ,তখন এই বাড়িতেই থাকতেন বলে অনুমান করা হয়।
কিভাবে বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্যানিংয়ের স্মৃতি? এই বাড়িটি ছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির সদর দপ্তর। 1872 এই সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়, আর এখানেই প্রশ্ন কেন ? তার উত্তর দিতে হলে বলতেই হয়, একটি বন্দর চালাতে লাগে প্রচুর পরিমাণে অর্থ, সে অর্থের জোগান নিয়েই পোর্ট ক্যানিং বন্দর কাজ শুরু করে। এই বন্দর থেকে ছোটো ছোটো জাহাজে করে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের নামে আদতে ক্রীতদাস বিভিন্ন ইংরেজ উপনিবেশে পাঠানো হতো, এমনই সময় জানা যায় একটি জাহাজ শ্রমিক সমেত ডুবে যায়। এর পর থেকেই সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী এই পোর্ট ক্যানিং বন্দর থেকে এই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ হয়। সেই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক সরবরাহের কাজ চলে পরবর্তীকালের সুরিনাম ঘাট থেকে। অন্যদিকে পলির কারনে পোর্ট সংলগ্ন নদীগর্ভের নাব্যতা কম হওয়ায় বড় জাহাজগুলিও এখানে আর নোঙর করতো না। এছাড়াও স্থানীয় ঠিকা শ্রমিক ও মাঝি দের অসহযোগিতাতো ছিল এই পোর্ট বন্ধ হওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারণ।
পোর্টের কর্মচারিগণ ইচ্ছা মতো জঙ্গলের গাছ কেটে নিজ ব্যবসা সিদ্ধি করতেন ফলে, এই উপকূলবতী অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়ার শক্তি হারায়, ফলে যখন সাইক্লোন পুরো শক্তি নিয়ে ক্যানিং তথা উপকূলীয় অঞ্চলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পোর্টের কর্মচারিদের কৃতকর্মের জন্য এই উপকূলীয় অঞ্চল সেই সাইক্লোনকে বাধা দিতে পারে নি, পোর্টের জেটিগুলোতে 6 থেকে 7 ফুটের উপরে জলোচ্ছাস হয়েছিল। অবস্থার একটু উন্নতি হলে, সরকার সব ঠিকথাক করে আবার পোর্টটি চালু করে। কিন্তু 1868 থেকে 1870 সালের মধ্যে মাত্র 3টি জাহাজ আসে ক্যানিং পোর্টে। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার ক্যানিং পোর্টকে ‘নিঃশুল্ক বন্দর’ ঘোষণা করে দেন, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অবশেষে 1870 সালে সরকার পোর্ট ক্যানিং বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রাচীন ভবনটির অবস্থা খুবই জীর্ণ। খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। দোতলা বাড়ির উপরও নিচ মিলিয়ে প্রায় এগারোটি ঘর আছে। লোহার মূল ফটক টি বহুকাল আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে।
পুরু দেয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে এই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। কড়ি কাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত 15 ফুট। ভূগর্ভের নিচে একটি তল আছে। যেটি সেই সময়ে ব্যবহার হতো। বহুকাল ব্যবহৃত না হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে সেই সুরঙ্গ পথটি।
ইংরেজ আমলের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র এই বাড়িটিতে ছিল। যা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে বা বিক্রি হয়ে গেছে প্রশাসনের অজান্তেই।
ভয়ানক আমপান ঝড়ে অর্ধ-ভগ্নপ্রায় সেই বাড়িটি এবার সত্যি সত্যি ভেঙে পড়তে চলেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু তথ্য আবার মাটিতে মিশে যেতে চলেছে, আমাদের কাছে এ খুব হতাশার খবর।
তথ্যসূত্র—
দক্ষিণ 24 পরগণা সমগ্র : জেলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব – মহাদেব গুড়িয়া
আনন্দবাজার পত্রিকা ক্যানিং এর বাড়ি সংরক্ষণ শীর্ষক প্রবন্ধ – অশোক সেনগুপ্ত
একটা বিলুপ্ত বন্দর, আর একটা ভাঙা বাড়ির গল্প – সলিল হোড়।
( লেখক – শুভজিত দে। )
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,