রাশিয়া সাত বছর ধরে নিজেদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করেছে। লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমা বিশ্বের সমন্বিত নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হলেও যাতে রুশ অর্থনীতি ভেঙে না পড়ে। এখন ইউক্রেনে রুশ সামরিক হামলা শুরুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর প্রভাব কেমন হতে পারে, এটা নিয়ে চলছে আলোচনা।
এ বিষয়ে লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টিএস লম্বার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টোফার গ্রানভিল বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব রাশিয়ার ওপর পড়বে না—এমন ধারণা ঠিক নয়। এখনই হয়তো এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা রাশিয়ার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে। জার্মানিতে রুশ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের ১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেমিকন্ডাক্টরের মতো প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে রাশিয়ার প্রবেশগম্যতা সীমিত করা হয়েছে। এর বিপরীতে রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার আঘাত সামাল দিতে চাইছে মূলত দুটো বিষয়ের ওপর ভর করে। প্রথমটি, প্রায় ৬৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ। অন্যটি, তেল ও গ্যাস খাতের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব।
এদিকে রাশিয়ার বার্ষিক জিডিপির চলতি হিসাবে ৫ শতাংশ উদ্বৃত্ত রয়েছে। দেশটির ঋণ টু জিডিপি অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। এসব হিসাব ২০১৪ সালের পরের। ওই সময় পুতিন ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেন। তখন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো।
ক্রিস্টোফার গ্রানভিল বলছেন, ইউক্রেন সংকটের জেরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে।
এটা চলতি বছর রুশ তহবিলে বাড়তি ১ হাজার ৭২০ কোটি ডলার যুক্ত করতে পারে। এটা পুতিনের জন্য বড় একটি পাওয়া। তবে যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে বৈশ্বিক অর্থনীতি, বাজার ও বিনিয়োগ খাতে বিচ্ছিন্ন দেশে পরিণত করার ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশ্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রতিকূল রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে রাশিয়া।
নিষেধাজ্ঞার নেতিবাচকতা রাশিয়ার অর্থনীতি ও জনজীবনে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে বলেও মনে করছেন ক্রিস্টোফার গ্রানভিল। তিনি বলেন, এর লক্ষণ ইতিমধ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দেশটির গৃহস্থালি আয় এখনো ২০১৪ সালের তুলনায় কম রয়েছে। কমেছে বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশটির বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি ডলারের সমতুল্য। ২০১৩ সালে তা ছিল ২ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের।
ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ সের্গেই গুরিয়েভ বলেন, ২০১৩ সালে রাশিয়ার মাথাপিছু জিডিপি চীনের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। এখন দেশটি চীনের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ওই সময় রাশিয়া উচ্চ আয়ের দেশ ছিল। এখন মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও রাশিয়ার প্রতি আগ্রহ হারাতে শুরু করেছেন। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগানের একটি জরিপে বলা হয়েছে, রুশ মুদ্রা রুবলের বৈদেশিক বন্ডের পরিমাণ দুই দশকের সর্বনিম্নে নেমেছে। ইকুয়িটি বিনিয়োগ ক্রিমিয়া সংকটের আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি রাশিয়া। বিনিয়োগকারীদের আপত্তির আরেকটি জায়গা, ডলারের বিপরীতে দেশটির ঋণের পরিমাণ। গত বৃহস্পতিবার এটা ১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট ছাড়িয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। এমনকি তা উদীয়মান বাজারগুলোর গড়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ।
যুক্তরাষ্ট্রের পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের বাণিজ্য ও নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জেফরি স্কট বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে আরও কার্যকর স্ববিনিয়োগে বাধ্য করবে। দেশটি শিল্প ও সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বাধ্য হবে। এর মধ্যে যদি দেশটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফট-এ প্রবেশগম্যতা হারায়, তবে ঝুঁকি আরও বাড়বে। রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানি খাতে বড় আঘাত আসবে।
জেপি মরগান পূর্বাভাস দিয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার জের ধরে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস) রাশিয়ার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগ সীমিত হয়ে এলে মূলধন সংকটে পড়তে পারে রুশ জ্বালানি কোম্পানিগুলো।
এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এমন পরিস্থিতি বাস্তব হলে দেশটিতে জনরোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকেরা। জার্মান বিনিয়োগ ব্যাংক ব্যারেনবার্গ বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে রুশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক নোটে লিখেছে, ‘স্বৈরাচারী মনোভাব অগ্রগতির পাথেয় হতে পারে না।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,