লেখক: মহিউদ্দিন ঢাকা।
জ্বালানি তেলের বকেয়া বিল পরিশোধে ডলারের বিকল্প খুঁজছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। চীনের সঙ্গে ইউয়ান ও ভারতের সঙ্গে রুপিতে বিল পরিশোধের চিন্তা করছে বিপিসি। ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বিপিসি।
এর আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লেনদেনের জন্য ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারে সম্মত হয়েছে রাশিয়া ও বাংলাদেশ। বিপিসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে ইউয়ান ব্যবহারে চীনকে একটি প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরেই জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে নিয়মিত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না ব্যাংকে। বকেয়া বিল পরিশোধে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানির চাপও বাড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ১১ মে চিঠি পাঠিয়েছে বিপিসি। এতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা ডলার-স্বল্পতার কারণে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুসারে ডলার সরবরাহ না করায় আমদানি মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় জ্বালানি তেলের আমদানি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জ্বালানি বিভাগকে চিঠিতে অনুরোধ করেছে বিপিসি। চিঠিতে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ভারতীয় মুদ্রায় ঋণপত্র খোলা ও মূল্য পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মত হলে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে পারে। এরপর এটি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। এসব কাজ শেষ হলে ভারতের তেল সরবরাহ কোম্পানিকে রুপিতে বিল পরিশোধের বিষয়টি জানানো হবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নিতে হবে।
বিপিসি বলছে, ওয়ান ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, এসসিবি, এইচএসবিসি আগে জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খুললেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে তারা তা দিচ্ছে না।
মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আনতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় বিপিসির। এর মধ্যে সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক মাসে চার থেকে পাঁচটি করে ঋণপত্র খুলছে। আর অগ্রণী ব্যাংক একটির বেশি ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কোটি ডলারের বিল বকেয়া পড়ে আছে। এতে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে বিপিসির কাছে তেল বিক্রি করা বিদেশি কোম্পানিগুলো।
জ্বালানি বিভাগে পাঠানো চিঠিতে বিপিসি জানায়, গত জানুয়ারি থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করেছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (আইওসিএল)। মে পর্যন্ত পাঁচটি কার্গো জাহাজ সরবরাহের কথা ছিল তাদের। কিন্তু শুরুর দিকে সরবরাহ করা দুই জাহাজ জ্বালানি তেলের বিল নির্ধারিত সময়ের পরও পরিশোধ করা যায়নি। এ কারণে বাকি তিনটি জাহাজ সরবরাহ করেনি তারা।
২০১৬ সাল থেকে ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে ডিজেল নেয় বিপিসি। আগে ডিজেল ওয়াগনের মাধ্যমে নিলেও এখন দুই দেশের মধ্যে তৈরি করা মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। গত ১৮ মার্চ এ পাইপলাইন দিয়ে দেশে জ্বালানি তেল আসা শুরু হয়েছে।
বিপিসি চিঠিতে বলেছে, মে থেকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নুমালিগড় থেকে ৫৮ হাজার টন ডিজেল কেনা হবে। একই সময়ে আইওসিএল থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন ডিজেল এবং ৩০ হাজার টন জেট ফুয়েল (উড়োজাহাজে ব্যবহৃত) কেনা হবে। এর জন্য ১৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১ হাজার ২০৯ কোটি রুপি লাগবে।
বছরে বিপিসির প্রায় ৬০ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে। এর মধ্যে দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের এ চাহিদা মূলত পূরণ করে আসছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। এর বাইরে ডিজেল, পেট্রল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল আসে ৪৫ লাখ টন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড, চীন ও ভারত থেকে এসব জ্বালানি তেল আনে বিপিসি। তবে দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশ সরাসরি আমদানি করা হয়।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত থেকে আগামী সাত মাসে যে পরিমাণ ডিজেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, তা এ সময়ে মোট ডিজেল আমদানির ১৪ শতাংশের মতো। তবে পরিবহন খরচ কম থাকায় ভারত থেকে ডিজেল আমদানি বাড়াতে চায় সরকার।
বিল পরিশোধে ডলারের বিকল্প হিসেবে রুপি বা ইউয়ানের ব্যবহারের বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতির বিষয় আছে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিপিসির চাহিদামতো রুপি বা ইউয়ান থাকতে হবে। সেই রুপির সঙ্গে টাকা ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণেরও ব্যাপার আছে। ডলার-সংকটের মধ্যে এটি হয়তো বিবেচনা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তাদের কাছে খুব বেশি রুপি বা ইউয়ান থাকার কথা নয়। এটা দিয়ে কিছু বিল হয়তো পরিশোধ করা যাবে, কিন্তু খুব বেশি বড় বাণিজ্য করা যাবে না।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২০, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,