মনোযোগ ধরে রাখার উপায় হিসেবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এর ব্যবহৃত ”রুজভেল্ট ড্যাশ” একটি অসাধারণ পদ্ধতি।
অনেকেই হয়তো জানেননা রুজভেল্ট ইতিহাসের অন্যতম প্রোডাক্টিভ মানুষ। তিনি মাত্র ৬১ বছরের মত বেঁচে ছিলেন (১৮৫৮-১৯১৯) – কিন্তু এই ছোট জীবনেই তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়েছেন, সেনাবাহিনীতে কর্ণেল হয়ে যুদ্ধ করেছেন, নিউ ইয়র্কের গভর্ণর হয়েছেন, এবং মাত্র ৪২ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এতকিছুর মাঝে তিনি ৪০টি বই রচনা করেছেন!
কম সময়ে এত প্রোডাক্টিভ ভাবে কাজ করার পেছনে তাঁর ব্যবহার করা মনোযোগ ধরে রাখার উপায় রুজভেল্ট ড্যাশ অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
দীর্ঘ সময় নয়, গভীর ফোকাস
মজার ব্যাপার হল রুজভেল্ট দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতেন না। কিন্তু তাঁর টাইম ম্যানেজমেন্ট এতই ভালো ছিল যে, তিনি অল্প সময়েই অনেকটা কাজ করতে পারতেন। লম্বা সময় ধরে কাজ করার বদলে তিনি এমন একটি পদ্ধতিতে কাজ করতেন, যাতে গভীর ভাবে কাজে মনোযোগ থাকে। তাঁর এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে আরও মনোযোগ বৃদ্ধি করার কৌশল যেমন, পমোডরো টেকনিক এবং ডিপ ওয়ার্ক মেথড এর সৃষ্টি হয়েছে। এই সব পদ্ধতিগুলোর মূল আইডিয়াই হল, একটি নির্দিষ্ট সময় শুধুমাত্র একটি কাজেই নিজের সমস্ত মনোযোগ বা ফোকাস দেয়া। পমোডরো এবং ডিপ ওয়ার্ক নিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই কাজ করেছি, আজ আপনার মনোযোগ ধরে রাখার দক্ষতাকে আরও শক্তিশালী করতে রুজভেল্ট ড্যাশ পদ্ধতি জানাবো।
[থিওডোর রুজভেল্ট]
মনোযোগ ধরে রাখার উপায়, রুজভেল্ট ড্যাশ যেভাবে কাজ করে
এটি যদিও খুবই কার্যকর একটি উপায়, কিন্তু এটা খুব কঠিন কিছু নয়। কিছু বিশেষ ধাপ অনুসরন করলেই এটা খুব সহজে করা যায়। আসল ব্যাপার হল চর্চাটা ধরে রাখা। রুজভেল্ট ড্যাশ পদ্ধতিতে মনোযোগ ধরে রাখার ধাপগুলো অন্যান্য অনেক জায়গায় হয়তো আলাদা আলাদা ভাবে জেনেছেন। কিন্তু এগুলো একসাথে অনুসরন করলে আপনার প্রোডাক্টিভিটি অনেকটাই বেড়ে যাবে। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক রুজভেল্ট ড্যাশ পদ্ধতিতে মনোযোগ ধরে রাখার উপায়।
০১. সবচেয়ে জরুরী কাজটি বেছে নিন
এটা যদিও খুব সাধারণ, কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন ব্যাপারটা কতটা জরুরী। আপনি যদি আপনার কাজ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরী কোনটা – এটা না বোঝেন – তাহলে একটি কাজের মধ্যে আরেকটি কাজের চিন্তা আপনাকে বিরক্ত করবে।
পূর্ণ ফোকাস রাখার জন্য আপনাকে এমন একটি কাজ বেছে নিতে হবে – যেটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ এবং যেটি সফল হলে আপনি বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবেন। এতে করে এই কাজটি করার সময়ে অন্য কাজের চিন্তা মাথায় আসবে না।
এছাড়া, আপনি একটি দিনের বা কয়েক দিনের কাজ ক্রম অনুসারে সাজিয়ে নিতে পারেন। কোন কাজটির পর কোন কাজটি করবেন – তা ঠিক করা থাকলে মাথা অনেক হাল্কা থাকে। না হলে একটি কাজ শেষ করার পর কোন কাজটি করবেন – এই চিন্তাও মনোযোগ নষ্ট করতে পারে।
ধরুন আপনি একটি বাজেট করবেন। এখন বাজেট করার জন্য আপনার বিভিন্ন রকমের তথ্য প্রয়োজন হবে। এখন কোন তথ্যটি আগে সংগ্রহ করবেন, কোনটি পরে করবেন- তা আগে থেকে ঠিক করে না রাখলে একটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময়ে অন্য বিষয়ের চিন্তা মাথায় চলে আসতে পারে।
এই ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মানুষ একটি কাজ ছেড়ে আরেকটি কাজে মনোযোগ দিয়ে ফেলে। এবং এটা প্রায়ই ঘটে নিজের অজান্তে। অন্য কাজটি করার এক পর্যায়ে আবার আগের কাজটির কথা মনে পড়ে যায়, তখন হাতের কাজ বন্ধ করে আবারও আগের কাজে ফিরে যায়। এতে করে কোনও কাজেরই পূর্ণ মনোযোগ থাকে না, এবং অনেকটা সময় নষ্ট হয়।
কিন্তু কোন কাজটির পর কোন কাজটি করা হবে – এটা আগে থেকে ঠিক করা থাকলে, এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যায়।
০২. কাজ করতে কত সময় লাগবে, তা বোঝার চেষ্টা করুন
মনোযোগ
রুজভেল্ট ডট পদ্ধতিতে মনোযোগ ধরে রাখার জন্য একটি কাজ করতে কত সময় লাগতে পারে – তার বিষয়ে আগে থেকে একটা ধারণা করে রাখাটা জরুরী। যে কাজেই হাত দেয়ার প্রস্তুতি নিন না কেন, আগে থেকেই সেই কাজের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা করুন। এটা যে সব সময়ে পারফেক্ট হতে হবে – এমন কোনও কথা নেই। মোটামুটি একটা ধারণা হলেই চলবে।
এতেকরে, কাজ শুরু করার পর একটু সময় পরই মনোযোগ অন্য দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। কারণ, আপনি জানেন কাজটি করতে আপনার কতক্ষণ লাগতে পারে। একারণে সেই নির্দিষ্ট সময়টি পর্যন্ত আপনার মন ও মস্তিষ্ক এই কাজটিতেই ফোকাস করার চেষ্টা করবে। সেই সময়ের আগে মন অন্যদিকে কম যাবে – এবং আপনি অনেক বেশি ফোকাসের সাথে কাজ করতে পারবেন।
০৩. সময়ের আগে ডেডলাইন সেট করুন
আগের ধাপে কাজ শেষ হতে কতক্ষণ লাগতে পারে – সেই ব্যাপারে একটা ধারণা পেয়েছেন। এখন তার চেয়ে একটু কম সময় ধরে ডেডলাইন সেট করুন।
মনে করুন, একটি কাজ করতে আপনার ২ ঘন্টা লাগবে বলে আপনি ধারণা করেছেন। এখন ডেডলাইন সেট করার সময়ে ২ ঘন্টার চেয়ে কম সেট করুন। এবং সেই সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করার চেষ্টা করুন।
তবে প্রথমেই ২ ঘন্টার কাজ ১ ঘন্টায় করার চেষ্টা করবেন না। হয়তো ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট বা তারও কম করতে পারেন। এটাকে ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকবেন – যতটা মানুষ হিসেবে আপনার পক্ষে সম্ভব হয়। এই বিষয়টা প্রাকটিস করলে দেখবেন যে কোনও কাজই আগের চেয়ে অনেক কম সময়েই ভালো ভাবে করার অভ্যাস হয়ে যেতে থাকবে। আর কম সময়ে বেশি কাজ করার মাইন্ডসেট থাকলে এমনিতেই অন্যদিকে মনোযোগ যাওয়ার বদলে হাতের কাজের ওপরই সম্পূর্ণ ফোকাস দেয়ার অভ্যাস হতে থাকবে।
রুজভেল্ট ড্যাশের মাধ্যমে মনোযোগ ধরে রাখার উপায় চর্চা করার জন্য এই ধাপটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই মূলত আপনার মানসিকতা ও ফোকাসকে প্রতিদিন শক্তিশালী করবে।
০৪. পারফেক্ট করার চেয়ে শেষ করায় গুরুত্ব দিন
পারফেকশনিস্ট হওয়া ভালো। কিন্তু সব সময়ে পারফেক্ট কাজ করতে গেলে সময়ের সাথে দৌড়ে পারবেন না। সেরা প্রোডাক্টিভিটির সাথে যারা কাজ করেন, তারা আগে ডেডলাইনের মধ্যে কাজটি শেষ করেন – এবং পরে সেটির ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করেন।
এবং এই ভুল ত্রুটি খোঁজার জন্যও সময় নির্দিষ্ট করা থাকে। কাজ করার সময়ে পারফেক্ট বা নিখুঁত ভাবে করতে গেলে আপনাকে অনেক ধীরে কাজ করতে হবে। একটু কাজ করার পর, আবার সেটুকু বিচার করতে হবে। এতে করে অনেক বেশি সময় অযথা খরচ হয়। সেইসাথে, এভাবে কাজ করতে গেলে কাজের প্রতি পূর্ণ ফোকাসও দেয়া হয় না। অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে মিলিয়ে বিচার করতে গিয়ে আসল বিষয় থেকেও মাঝে মাঝে সরে আসতে হয়। কাজেই, পূর্ণ ফোকাসে কাজ করার জন্য কাজ নিখুঁত করার বদলে আগে শেষ করায় মন দিন। তারপর সেগুলোর ভুল ত্রুটি অন্য সময়ে ধরুন।
০৫. অন্য সবকিছু ভুলে যান
এটা আসলে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও এটি একটি ধাপ হিসেবে ধরা হয়, কারণ এটাই রুজভেল্টের মনোযোগ ধরে রাখার উপায় এর মূল দর্শন। যখন যে কাজ করছেন, তখন পৃথিবীর বাকি সবকিছু ভুলে যান। বর্তমান যুগে এটা আরও সত্য। ফোন, মেইল, মেসেজ, সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন প্রতিনিয়ত কাজের ওপর থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে কাজের মান আগের মত ভালো হচ্ছে না।
কাজের সময়ে ফেসবুক, নিউজ – ইত্যাদির কাছে ভুলেও যাবেন না। পারলে ফোনও বন্ধ রাখুন। একটি গোপন নম্বর রাখতে পারেন, যেটি শুধু পরিবার ও অল্প কিছু মানুষের কাছে থাকবে – এবং বলা থাকবে খুব বড় ইমার্জেন্সী না হলে যেন আপনাকে এই নম্বরে কল দেয়া না হয়।
এইসব ব্যবস্থা নিতে পারলে অনেক বেশি মনোযোগের সাথে কাজ করতে পারবেন।
পরিশিষ্ট
সময় ও কাজের যোগফলই হল জীবন। একজন মানুষ তার সময়কে যত ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে – তার জীবন তত সার্থক হবে। অল্প সময়ে বেশি কাজ করতে পারা মানে নিজের সাফল্য আর লক্ষ্যকে আরও অনেক দ্রুত কাছে পাওয়া। মানুষ বড় হয় একটির পর একটি লক্ষ্য পূরণ করে। একটি লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর আরও বড় লক্ষের দিকে ছোটাই মানুষকে অন্যদের চেয়ে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। আর পূর্ণ মনোযোগে কাজ করতে পারাই হল অল্প সময়ে বেশি কাজ করার গোপন রহস্য।
সূত্র: নেট থেকে সংগৃহীত (লড়াকু)
তারিখ: জানুয়ারী ০৬, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,