লেখক:সানাউল্লাহ সাকিব।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল ও তেলের দাম বেড়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে জাহাজের ভাড়াও। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। এর চাপ গিয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। কারণ, আমদানি যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। আবার প্রবাসী আয়ও কমে গেছে। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে জোগান দিতে হচ্ছে আমদানির খরচ। এ অবস্থায় চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে সবচেয়ে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
এখন যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আবার আমদানি খরচ এভাবে বাড়তে থাকলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে রিজার্ভের হিসাব সঠিক নিয়মে করার। সেটি করতে গেলে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানিকারকদের ঋণ তহবিল, সরকারি প্রকল্প ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণ এবং সোনালী ব্যাংকে রাখা আমানত রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ কমবে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি। এখন রিজার্ভ রয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে আশার কথা, রপ্তানি আয় বেশ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে পোশাকের পর হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছেছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিও শতকোটি ডলার ছুঁই ছুঁই করছে।
আর পরিকল্পনা করে জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে ও অবৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় ঠেকানো গেলে বৈধ পথে প্রবাসী আয়ও ভালো আসবে। এতে আমদানি বাড়লেও রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হবে না। এরই মধ্যে বিলাসপণ্য আমদানি ঠেকাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের সংকট মোকাবিলায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। এ ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। অর্থনীতিবিদেরাও বলছেন, সংকট বা চাপ আরও বাড়ার আগে দ্রুত বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমদানিতে বড় উল্লম্ফন
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি খরচ হয় শিল্পের কাঁচামালে। খরচের তালিকায় এর পরের অবস্থান ভোগ্যপণ্যের। খরচের হিসাবে জ্বালানির অবস্থান পঞ্চম। চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয় ২ হাজার ২১৩ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৪ শতাংশ বেশি। তবে আমদানি খরচ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জ্বালানিতে। গত জুলাই-মার্চ সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৭ শতাংশ আমদানি খরচ বেড়ে গেছে জ্বালানিতে। গত জুলাই-মার্চে আমদানি হয় ৫৪৬ কোটি ডলারের জ্বালানি। গত জুলাই-মার্চে ভোগ্যপণ্যের আমদানি খরচ বেড়েছে ৪১ শতাংশ, মূলধনি যন্ত্রের ৪২ শতাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানিতে ৫০ শতাংশ। এর ফলে সামগ্রিকভাবে জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানি খরচ বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া মানে আমদানি বেড়ে যাওয়া নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ও জাহাজের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে, শিগগিরই এ খরচ কমার সম্ভাবনা নেই। তবে যথাযথ পণ্য আমদানি হচ্ছে কি না, তার তদারকি বাড়াতে হবে। এতে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার কমে আসবে। আমদানি খরচও কমবে।
এদিকে বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে কোনো আমদানিকারক ১ কোটি টাকা দামের গাড়ি আনতে চাইলে ৭৫ লাখ টাকা ব্যাংকে অগ্রিম জমা দিতে হবে। এর ফলে আমদানি খরচ কমে আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রপ্তানি ইতিবাচক, প্রবাসী আয় নিম্নমুখী
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পণ্য রপ্তানিতে বেশ ভালো করেছে বাংলাদেশ। তাতে দুই মাস বাকি থাকতেই চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তার কাছাকাছি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ।
তবে একই সময়ে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় সব প্রবাসী আয় বৈধ পথে দেশে এসেছিল। আর এখন ব্যাংকে ও খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য আট টাকা ছাড়িয়েছে, এ জন্য অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা আবারও বাড়ছে। আর বৈধ পথে কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-এপ্রিলে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ডলার। ২০২০–২১ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২ হাজার ৬৬ কোটি ডলার।
রিজার্ভে চাপ কেন
গত মার্চে রপ্তানি আয় হয় ৪৭৬ কোটি ডলার; আর প্রবাসী আয় আসে ১৮৬ কোটি ডলার। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় মিলিয়ে মার্চে ৬৬২ কোটি ডলারের আয়ের বিপরীতে আমদানি দায় শোধ করতে হয় ৭১৪ কোটি ডলার। তাতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২ কোটি ডলার। তবে জুলাই-মার্চের হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ কোটি ডলার আয় উদ্বৃত্ত আছে। আমদানি খরচ বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৫২০ কোটি ডলার, এতে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
আর ডলারের ওপর চাপ বাড়ায় বাড়ছে দাম। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলারের জন্য নিচ্ছে ৯৫ টাকার বেশি। যার প্রভাব পড়ছে ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানিপণ্যে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যতটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, জনগণের ওপর চাপ ততই কমবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন,আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে আমদানি চাপ কিছুটা কমবে। তবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে দক্ষ হাতে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ১৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,