রিকশা বা রিক্সা বা সাইকেল রিকশা একপ্রকার মানবচালিত মনুষ্যবাহী ত্রিচক্রযান, যা এশিয়ার, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যবাহী বাহন। যদিও দেশভেদে এর গঠন ও আকারে বিভিন্ন পার্থক্য দেখা যায়। জাপানী রিকশাগুলো অবশ্য তিনচাকার ছিল না, সেগুলো দুই চাকায় ভর করে চলতো, আর একজন মানুষ ঠেলাগাড়ির মতো করে টেনে নিয়ে যেতেন, এধরনের রিকশাকে ‘হাতেটানা রিকশা’ও বলা হয়। সাধারণত ‘রিকশা’ বলতে এজাতীয় হাতে টানা রিকশাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সম্প্রতিককালে (২০১১) সাইকেল রিকশায় বৈদ্যুতিক মোটর সংযোজন করার মাধ্যমে যন্ত্রচালিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এজাতীয় রিকশার প্রচলন দেখা যায়।
পালকির বিকল্প হিসেবে ১৮৬৫-৬৯ প্রথম কে এর উদ্ভাবন করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হলো – জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানের সিমলায়। ১৯০০ সালে কলকাতায় হাতে টানা রিকশা চালু হয়, তবে মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪ সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ততদিনে ব্রক্ষদেশ মানে মিয়ানমারের রেঙ্গুনেও রিকশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে রিকশা আসে চট্টগ্রামে। তবে ঢাকায় রিকশা চট্টগ্রাম থেকে আসেনি; এসেছে কলকাতা থেকে। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন। রিকশার বহুল ব্যবহার এবং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর কারণে ঢাকাকে বিশ্বের রিকশার রাজধানী বলা হয়।
রিকশা তার উৎপত্তিক্ষেত্র জাপান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। তবুও রিকশার বিস্তৃতি মূলত এশীয় ও পূর্ব-এশীয় দেশগুলোতে বেশি লক্ষ করা যায়।
১৯১৯ সালের কথা ঢাকায় জনপ্রিয় হতে লাগলো রিকশা।অনেকের মতে কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে।
আবার বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রিকশা আসে মায়ানমার থেকে।
কিন্তু এই বাহনে ওঠার জন্যে মানুষকে কীভাবে আকৃষ্ট করা যাবে?
রিকশা-চালকরা এবং মালিক সম্প্রদায় তখন পড়লেন ভারী বিপাকে। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে, মানুষকে রিকশার প্রতি আকৃষ্ট করার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে রিকশায় আঁকাআঁকির চিন্তা শুরু হয়। যেহেতু আলপনা, সিনেমার পোস্টার, নকশা এসবের পেছনে বাঙ্গালীর একটা আগ্রহ আদিকাল থেকেই আছে। তাই এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রিকশা-আর্ট নামক একটি বিষয় শুরু হয়। ‘রিকশা আর্টিস্ট’ নামে একদল মানুষও আত্মপ্রকাশ করে রাতারাতি।
পঞ্চাশের দশকে যখন রিকশা এসেছে এ দেশে, প্রথম প্রথম শুধু ফুল-পাখি, জীববৈচিত্র্য, নানারকম নকশার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো রিকশা-আর্ট এর কাজ। কিন্তু আস্তে আস্তে রিকশা-আর্টের বিষয়বস্তু হিসেবে যুক্ত হতে থাকে সমসাময়িক সবকিছু।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পরে যুদ্ধের বিভিন্ন টুকরো টুকরো দৃশ্য আঁকা হতো রিকশার গায়ে। স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার, কল্পিত স্বাধীন দেশের টুকরো ছবি যুক্ত হওয়া শুরু করে রিকশা-দেহে। এছাড়া সিনেমার দৃশ্য তো আছেই। সিনেমা, জীব-বৈচিত্র্য, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযাপন…সবকিছু তুলির ডগায় ফুটে উঠতো রিকশায়। মিথোলজির নানা উপাদান– দুর্গাপূজা, কালীপূজা, রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য, আরব্য রজনী-পারস্য রজনীর গল্প,বিখ্যাত মসজিদ, তাজমহল, আলিফ লায়লা- সবই ছিলো রিকশা-আর্টের টপিক।
দিন যত গড়ায়, রিক্সায় ভরে যায় পুরো শহর। রোদঝড়জলবৃষ্টি যা-ই হোক, রাজপথে রিক্সাচালকদের ছুটি নেই। হঠাৎই কান পাতলে শুনবেন কেউ হাঁকছে ‘এই মামা যাইবেন?’ একটু দামাদামি করে উঠে পড়ুন রিক্সায়। রিক্সাচালকও আপনাকে মামা বা খালা বলবেন। যদি একটি বার বলেন যে আপনার তাড়া আছে, রিক্সামামা অভয় দিয়ে বলবেন, ‘চিন্তা কইরেন না টাইম মতো পৌঁছায়া দিমু।’
ঢাকায় রিক্সার সংখ্যা ঠিক কত, তা অনুমান করা বেশ কঠিন। ইতিহাস বলছে, ১৯১৫ সাল নাগাদ ঢাকায় রিক্সার সংখ্যা ছিল নাকি মাত্র ৩৭। এখন পাঁচ লাখের বেশি। এবং, ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ লোক নাকি রিক্সাতেই যাতায়াত করে। সাধে কি আর বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ ঠাঁই পেয়েছে ঢাকার রিক্সা!..
ঢাকাকে বলাই হয় রিক্সা আর মসজিদের শহর। কিছু ভিআইপি রোড বাদ রাখুন, ঢাকার অন্য সবখানে সবথেকে জনপ্রিয় বাহনটি কী যদি কেউ প্রশ্ন করেন, চোখ বুজে উত্তর হবে, রিক্সা! কখনও কাজের সময়, কখনও আবার হাওয়া খেতে বা স্রেফ ঘোরাঘুরির জন্যও রিক্সা চড়েন মানুষজন। বাচ্চাদের স্কুল টাইম, অফিস টাইম এবং কলেজ টাইমে এর কদর খুব বেড়ে যায়। রিক্সাচালকেরা তখন ভাড়াও হাঁকেন বেশি। ফলে, জ্যাম অনিবার্য। এটিও ঢাকার খুবই পরিচিত ছবি। বছরের যে কোনও সময় ঢাকার পথে রিক্সার জ্যাম।
পরিবেশবান্ধব এই রিক্সা ঢাকার মধ্যবিত্তদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় বাহন। তবে এটা ঠিকই যে, ঢাকার জ্যাম কমানোর জন্য এক বার রিক্সা উঠিয়ে দেওয়ার কথা চলছিল। কিন্তু পরে সেই মত ধোপে টেকেনি। তার মূল কারণটা এই যে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় দশ লাখ মানুষের রুটিরুজি। তাদের রোজগারের একমাত্র মাধ্যম এই রিক্সা। ফলে ঢাকা শহরে রিক্সা থেকেই গেল প্রিয় বাহন হিসেবে।
ঢাকাতে অবশ্য টানা রিক্সা নেই আর, রিক্সা চলে প্যাডেলে, ফলে টানা রিক্সার মতো চালকের অতটা পরিশ্রম হয় না। তিন চাকার এই ইকো-ফ্রেন্ডলি বাহনটিতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। বর্ষাকালে অঝোর বৃষ্টিতে রিক্সার হুড তুলে দিয়ে যাঁরা ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাঁরাই জানেন যে, কতটা রোমান্টিক সেই সফর!
একটা সময় ছিল যখন ঢাকার রিক্সার পিছনে নানা রকম পেইন্টিং ছিল দেখার মতো। তখন কিছু শিল্পী ছিলেন, যাঁরা রং আর তুলি দিয়ে রিক্সার সওয়ারির আসনের পিছন দিকটিতে নানা কিছু আঁকতেন। সেখানে যেমন ফুল, পাখি, লতাপাতা ছিল, তেমনই ছিল নানা রকম প্রাকৃতিক দৃশ্য, কিংবা ধরুন সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি। কিন্তু, ডিজিটাল জমানায় তাঁদের কদর নেই বললেই চলে। সিনেমার হাতে আঁকা বিজ্ঞাপন যেমন জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে, সেই জায়গা দখল করেছে কম্পিউটার গ্রাফিক্স, ঠিক সে ভাবেই এখন কম্পিউটার-জেনারেটেড ছবিই সেঁটে দেওয়া হয় রিক্সার পিছন দিকে। চাইলেই নানা রকম ছবি মেলে, পাওয়া যায় তাড়াতাড়ি, টিকেও যায় হয়তো অনেক বেশি। কিন্তু, হাতে আঁকা ছবিতে শিল্পীর যে নিজস্ব ‘টাচ’ থাকত, অন্য রকম একটা প্রাণ থাকত, মেশিনে বানানো ছবিতে সে সব আর কোথায়? রিক্সা পেইন্টিং করতেন যাঁরা, তাঁদের এখন দু’বেলা পেট চালানোই কঠিন। বাধ্য হয়ে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।
তবে রিক্সা আছে যখন, তখন রিক্সার সঙ্গে জড়িয়ে নানা ধরনের জীবিকাও আছে। কেউ রিক্সা কিনে ভাড়া দেন, কেউ রিক্সার যন্ত্রপাতির ব্যবসা করেন। এর সবই পাওয়া যাবে পুরোনো ঢাকায়। রিক্সা মূলত পুরোনো ঢাকার বাহন। সেখানকার গলিতে গলিতে পাবেন রিক্সার গ্যারেজ।
বাংলাদেশে রিক্সা ঠিক কতটা জনপ্রিয়, তার একটা ছোট্ট দৃষ্টান্তের কথা বলে শেষ করি। যদি কখনও ঢাকায় যান, ধানমন্ডির রাপা প্লাজার কাছে ২৭ নম্বর সড়কে অন্তত একটি বার যাবেন। সেখানে আছে শিকল দিয়ে তৈরি একটি ভাস্কর্য। নাম ‘ইস্পাতের কান্না’। ভাস্কর্যটি মৃণাল হকের তৈরি। দেখলেই বুঝবেন, রিক্সাকে কতটা মর্যাদা দেওয়া হয় বাংলাদেশে। এমনকী, বিদেশ থেকে কেউ এলেও তাঁদের বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যবাহী বাহনটির সাথে পরিচিত করানো হয়।
সূত্র: সংগৃহিত এবং উইকিপিডিয়া
তারিখ: এপ্রিল ০৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,