ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এক সপ্তাহ পার হয়েছে। সাত দিনে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং অন্যান্য প্রধান শহর রুশ সেনাদের হামলার শিকার হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলো ঐতিহাসিক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর পারমাণবিক হামলা নিয়ে দুশ্চিন্তা স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। যুদ্ধ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানবিক সংকট।
রাশিয়া-ইউক্রেনের এক সপ্তাহের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে আল–জাজিরায়। একনজরে দেখে নেওয়া যাক গত এক সপ্তাহে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি।
হামলা যেভাবে শুরু
ন্যাটোতে যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া দেড় থেকে দুই লাখ সেনা মোতায়েন করে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের লুহানস্ক এবং দোনেৎস্কের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেন পুতিন। ওই অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট। ৫৫ মিনিটের একটি ভাষণে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেন পুতিন। তিনি এই সংকটের জন্য ন্যাটোকে দায়ী করেন। পুতিনের অভিযোগ ছিল, পশ্চিমা দেশের এই সামরিক জোটটি রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি।
গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্টকে থামাতে রাশিয়ার বেশ কিছু ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
রুশ বাহিনী তিন দিক থেকেই ইউক্রেনে অভিযান চালাতে শুরু করে। উত্তরে বেলারুশ, দক্ষিণে অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং পূর্বে রাশিয়া থেকে শুরু হয় এই হামলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া সবচেয়ে বড় পরিসরে এভাবে সেনা মোতায়েন করল।
ইউক্রেনের প্রতিরোধ
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামরিক আইন জারি করেন। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও অন্যান্য বড় শহরে রাশিয়া একের পর এক বিমান হামলা চালায় ও গোলাবর্ষণ করে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের খবরও জানা গেছে।
ইউক্রেনের জরুরি সেবা বিভাগ বলছে, হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত দুই হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। যদিও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয় বলেছে, হামলায় ১৩ শিশুসহ ১৩৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ইউরোপে শরণার্থী দ্রুত বাড়ছে। জাতিসংঘ বলেছে, ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে দেশটি থেকে ১০ লাখ মানুষ পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে বিশ্বে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পরমাণু অস্ত্রবিষয়ক বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্ক করে বলেছে, পারমাণবিক হামলা চালাতে বেলারুশকে ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া।
ইউরোপের পদক্ষেপ
কয়েক দশক পর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিত পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতিতে পৌঁছাতে পেরেছে। এই প্রথমবারের মতো যুদ্ধরত কোনো দেশে অস্ত্র ক্রয় ও সরবরাহের জন্য অর্থায়ন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউক্রেনকে অস্ত্রের জন্য ৫০ কোটি ইউরো দিচ্ছে ইইউ। জার্মানিও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে অস্ত্র পাঠানোর বিরুদ্ধে তার ঐতিহাসিক নীতি পরিবর্তন করে ইউক্রেনে অস্ত্র সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।
হেলেনিক ফাউন্ডেশন ফর ইউরোপীয় অ্যান্ড ফরেন পলিসির পরিচালক জর্জ প্যাগোলাটোস বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সমঝোতা হয়েছে আর রাশিয়ার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।
জর্জ প্যাগোলাটোস আরও বলেন, রাশিয়ার হামলার পর ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বদল এসেছে। প্রতিরক্ষা খাত জোরদারে দীর্ঘদিন ধরেই ফ্রান্স চাপ দিয়েছিল আর খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে জার্মানি এই পদক্ষেপ নেওয়ার বিরোধিতা করে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর দেখা যাচ্ছে, জার্মানি তার অবস্থান বদলেছে। জার্মানি বিশাল প্রতিরক্ষা প্যাকেজ অনুমোদন করছে। নতুন অনুমোদন পাওয়া ১০০ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিরক্ষা বাজেট বর্তমান প্রতিরক্ষা বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি।
অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর, মস্কোর স্টক এক্সচেঞ্জে ৪৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে।
শেয়ারবাজারের অস্থিরতা নিয়ে সতর্ক করেছেন জিয়াস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের মালিক স্টেলিওস জাভভোস। তিনি বলেন, আমরা জানি না যুদ্ধ কত দিন চলবে? এর অর্থ হলো—বাজারে ব্যাপক অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা থাকবে।
বিজ্ঞাপন
জাভভোস আরও বলেন, এই আক্রমণ জ্বালানি তেলেরও দাম বাড়াবে। আমাদের বিশ্লেষণ হলো, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার কিংবা এর বেশিও হতে পারে। পাশাপাশি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা সৃষ্টি করবে এটি। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে সেটি ব্যবসায়িক লেনদেন এবং পারিবারিক অবস্থা দুই দিকের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেমন সুইফট থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধু আর্থিক নিষেধাজ্ঞা নয়, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রুশ এয়ারলাইনসগুলোকে। এ ছাড়া রাশিয়ার সরকারি গণমাধ্যম রাশিয়া টুডে ও স্পুতনিকও নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি গত সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের অনুরোধ করেছেন।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী দাবি করেছে, বুধবার দক্ষিণ ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর খারসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তাঁরা। রাশিয়ার ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সামরিক বহর কিয়েভের পথে রয়েছে। ইউক্রনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভ এবং বন্দরনগরী মারিওপোল ঘিরে রেখেছে রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনের পতন হলে কী ঘটবে
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো সমীর পুরি বলেছেন, রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের পতন হলে কী ঘটবে? ইউক্রেনের দখল নেওয়া রাশিয়ার উদ্দেশ্য নয়। যদি ইউক্রেনীয়রা দীর্ঘদিন প্রতিরোধ চালিয়ে যাতে পারে, তাহলে দেশটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমীর পুরি মনে করেন, ইউক্রেনকে বেলারুশের মতো পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। যেটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, কিন্তু মস্কোর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে। আর পুতিন সম্ভবত এটাই চান।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০৩, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,