সূত্র: বিবিসি।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। এর পর তিন দিক থেকে রাশিয়া কিয়েভের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ইউক্রেনজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে রুশ সেনারা। এর মধ্যে রুশ সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলছে ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ইউক্রেনেরও বহু সেনা ও বেসামরিক মানুষ হরদম প্রাণ হারাচ্ছেন।
নবম দিনে গড়ানো এ যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কি এখনও তা পরিষ্কার নয়। তবে এর মধ্যে দুই দেশের আলোচনায় বসা আশাবাদী করে তুলছে।
এমন পরিস্থিতিতে এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। এতে পাঁচটি দৃশ্যকল্প বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
সংক্ষিপ্ত পরিসরে যুদ্ধ
এ প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পরিস্থিতি যেমন দাঁড়াতে পারে তা হলো— রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার মাত্রা বাড়াচ্ছে। প্রতিদিনি গোলা বর্ষণ ও রকেট হামলা করছে ইউক্রেনজুড়ে। চালানো হচ্ছে বিমানহামলাও। এ ছাড়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে চালানো হচ্ছে সাইবার হামলা। জ্বালানি সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বহু বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও পতন হলো কিয়েভের। আর বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে রাশিয়া তার পছন্দের কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হত্যা করা হলো বা তিনি পালিয়ে গেলেন। পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টে পুতিন বিজয় ঘোষণা করে সেখান থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহার করে নিলেন এবং কিছু সেনা সেখানে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য রাখলেন। ইউক্রেন পরিণত হলো বেলারুশের মতো রুশপন্থি রাষ্ট্রে।
এ ফল অসম্ভব নয়। তবে এটি নির্ভর করবে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর দুর্দান্ত সাফল্য এবং ইউক্রেনের অসাধারণ প্রতিরোধ চেতনা বিবর্ণ হচ্ছে কিনা তার ওপর। এর মাধ্যমে হয়তো পুতিন কিয়েভে সরকার পরিবর্তনে এবং ইউক্রেনে পশ্চিমাদের শক্তি খর্ব করতে সফল হবেন। তবে এটি হবে অবৈধ। এর কারণে সেখানে পরিস্থিতি সব সময় অস্থিতিশীল থাকবে। এ ছাড়া যে কোনো সময় সংঘাত শুরুর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ
এটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে গড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। দেখা গেল রাশিয়ার সেনারা দমে গেছে, তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে, রসদ সরবরাহ কমে গেছে বা নেতৃত্বে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সেনাদের কিয়েভের মতো শহর সুরক্ষিত করতে আরও বেশি সময় লেগে যাবে। কেননা, সেখানে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে। এ যুদ্ধ ১৯৯০ সালে চেচেনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি দখলে রাশিয়ার দীর্ঘ ও নৃশংস সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
যদিও রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের এ শহরে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে তবে তা ধরে রাখতে অনবরত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। হয়তো ইউক্রেনের মতো বড় দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাশিয়া এত সেনা পাঠাতে পারবে না। দেখা গেল ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী ধীরে ধীরে কার্যকরী বিদ্রোহী গ্রুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে যাদের সমর্থন দিচ্ছে স্থানীয় জনগণ। পশ্চিমারাও অস্ত্র ও সরঞ্জাম দিতে থাকল। এর পর, হয়তো অনেক বছর পর মস্কোতে নতুন নেতা এলেন। এর পর রাশিয়ার সেনারা নত হয়ে ইউক্রেন ছাড়ল। যেভাবে তাদের পূর্বসূরীরা প্রায় এক দশক লড়াই শেষে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছিল।
ইউরোপীয় যুদ্ধ
এটি কি সম্ভব যে, এ যুদ্ধ ইউক্রেনের সীমান্তের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে?
পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয়তো প্রেসিডেন্ট পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশ মলদোভা বা জর্জিয়া—যারা এখনও ন্যাটোর সদস্য নয়, সেখানে সেনা পাঠিয়ে দেশগুলো দখলের চেষ্টা করতে পারেন। এ ছাড়া তিনি ঘোষণা করতে পারেন, ইউক্রেনকে ইউরোপের অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি আগ্রাসন। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বাল্টিক অঞ্চলে সেনা পাঠানোর হুমকি দিতে পারেন, বিশেষ করে লিথুয়ানিয়ায়; যেন তা দখল করে রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ তৈরি করা যায়। বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলো আবার ন্যাটোর সদস্য।
এসব পদক্ষেপের কারণে ন্যাটোর সঙ্গে হয়তো খুবই ভয়ঙ্কর এবং ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। সামরিক জোটটির দলিলের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সদস্য কোনো রাষ্ট্রের ওপর হামলা মানে সবার ওপর হামলা।
যদি পুতিন মনে করেন তার নেতৃত্ব রক্ষার জন্য এ পদক্ষেপ একমাত্র উপায় তবে তিনি এ পথেই হাঁটবেন। যদি ইউক্রেনে তিনি পরাজিত হন তবে তিনি আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন এটিই অনুমেয়। আমরা এখন জানি, রাশিয়ার নেতা দীর্ঘ দিন ধরে আন্তর্জাতিক নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছুক। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এ কথা বলা যায়। কয়েকদিন আগেই পুতিন তার পারমণাবিক ফোর্সকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এর ব্যবহার আসন্ন কিনা তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষকই সন্দিহান।
কূটনৈতিক সমাধান
বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনও কি কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব?
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এখন অস্ত্র কথা বলছে। তবে আলোচনার পথ সবসময় খোলা রাখতে হবে।
এর মধ্যে আলোচনা চলছেও।
সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলও আলোচনা করেছে। তবে তারা সমাধানের দিকে খুব বেশি এগোতে পারেনি। তবে আলোচনায় পুতিনের রাজি হওয়া ইঙ্গিত করে, তিনি যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
কূটনীতিকরা বলছেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে রুশ নেতা জানেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে কী লাগবে। তাই একটি মুখরক্ষার চুক্তি অন্তত সম্ভব।
কল্পনা করুন— যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে রাশিয়া। বিরোধীতা বেড়ে যাওয়ার কারণে রাশিয়ার সেনাদের ফিরতে হচ্ছে। তখন পুতিন একে নিজের নেতৃত্বের জন্য হুমকি ভাবতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে চীন রাশিয়াকে হুমকি দিচ্ছে হামলা বন্ধ না করলে দেশটি মস্কোর কাছ থেকে তেল-গ্যাস কিনবে না। এর পর পুতিন একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
অপরদিকে ইউক্রেনের সরকার দেখলো যুদ্ধের কারণে তার দেশের অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং প্রচুর মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তার তখন ভাবছেন এটি চলতে দেওয়ার বদলে বরং রাজনৈতিক সমাধান অনেক বেশি ভালো। তখন কূটনীতিকরা আলোচনায় বসলেন এবং চুক্তি হয়ে গেল।
ক্রিমিয়া ও দোনবাসে ইউক্রেন রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিল। অপরদিকে পুতিন ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও ইউরোপের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক গভীর করার অনুমতি দিলেন। এটি অসম্ভব মনে হতে পারে। তবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ থেকে এমন একটি দৃশ্যের উদ্ভব হতে পারে তা একেবারে অসম্ভব নয়।
পুতিনের পতন
পুতিন ইউক্রেনে হামলার সময় বলেছিলেন, ‘আমরা যে কোনো পরিণতির জন্য প্রস্তুত’।
কিন্তু এ পরিণতির কারণে যদি তিনি ক্ষমতা হারান তবে কি হবে? এটি অকল্পনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। ফলে এ জাতীয় বিষয়গুলো এখন ভাবা হচ্ছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যান চলতি সপ্তাহে লিখেছেন, কিয়েভের মতো মস্কোতেও এখন ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা রয়েছে।
কেন তিনি এমন কথা বললেন। সম্ভবত, পুতিন একটি বিপর্যয়কর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখা গেল যুদ্ধে হাজার হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো ক্ষতি করতে শুরু করেছে রাশিয়ার। পুতিন ধীরে ধীরে জনসমর্থন হারাতে শুরু করেছেন। যা একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে।
এর পর তিনি তার অভ্যন্তরীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধীদের দমনে নির্দেশ দিলেন। ফলে রাশিয়ার সামরিক, রাজনৈতিক ও এলিটদের অনেকই পুতিনের বিরুদ্ধে চলে গেল। তখন পশ্চিমা বিশ্ব পরিষ্কার করে বলল, যদি পুতিন ক্ষমতা থেকে সরার পর একজন মধ্যমপন্থি নেতা রাশিয়ার নেতৃত্ব দেয় তবে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে এবং মস্কোর সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা হবে। এর পর ভয়াবহ একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটল, যার মাধ্যমে পতন হলো পুতিনের।
এটি এখনই সম্ভব মনে হচ্ছে না। তবে পুতিনের কাছ থেকে যারা উপকৃত হয়েছেন তারা যদি তাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন তবে এমন সম্ভাবনা অমূলক নয়।
সূত্রঃ সমকাল ।
তারিখঃ মার্চ ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,