জ্বালানি তেলের বাজারে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের বিকল্প উৎসের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, এমন সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ১৭ শতাংশ পড়ে যায়। এরপর দাম আবার ৩ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রতিবেদন লেখায় সময় জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১১৪ ডলার।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো ওপেকের সদস্যদেশগুলোকে তেলের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে। পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা বোঝার জন্য আরেকটি তথ্য দেওয়া যায়। সেটা হলো, ভেনেজুয়েলার কাছেও বার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তারা যেন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি করে। খবর বিবিসি ও নেক্সটার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু তারা এ বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে পাশ হওয়া বিলে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবের পক্ষে পড়েছে ৪১৪টি ভোট। বিপক্ষে ১৭টি। যুক্তরাষ্ট্রের জনমতের চাপে জো বাইডেন সরকার এই বিল পেশ করে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
আমেরিকার আইনসভায় এই বিল পাসের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যদেশগুলোকে নিয়ে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লা আমদানির ওপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা জারির পথে হাঁটতে পারবে বাইডেন সরকার।
রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারির উদ্যোগ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ওই দেশগুলোর অর্থনীতিতে। গত সপ্তাহে মস্কোর তরফে দাবি করা হয়েছিল, রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস নেওয়া বন্ধ করলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে ইউরোপের এক বছরের বেশি সময় লেগে যাবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর আপাতত তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকেরা।
পণ্য বাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিটিএনের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ট্রয় ভিনসেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর মোটেও নির্ভরশীল নয়। গত বছর রাশিয়া থেকে মোট আমদানির ৮ শতাংশের মতো জ্বালানি তেল এনেছে যুক্তরাষ্ট্র, আর এ বছরের জানুয়ারির পর রাশিয়া থেকে কোনো জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে আসেনি।
ট্রয় ভিনসেন্টসহ অন্য বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউরোপের মিত্রদেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চেয়েছিল। সেটিই ফলপ্রসূ হতো। কারণ, ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভরশীল। কিন্তু আপাতত সেটি সফল না হওয়ায় একাই নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের পর রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজেন্ডার নোভাক পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানির ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধের শামিল।
এটি জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রয়োজনে তার দেশ জার্মানির সঙ্গে যুক্ত নর্ড স্ট্রিম-১ গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দেবে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা এলে জ্বালানি তেলের বাজার আরও অস্থির হবে। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ সময় তিনি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাশিয়ার নেওয়া নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। গত মাসে এ প্রকল্পের অনুমোদন বাতিল করে জার্মানি। নর্ড স্ট্রিম প্রকল্পের চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে আলেক্সান্ডার নোভাক বলেন, ‘আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারি, কিন্তু আপাতত আমরা সেই পথে যাচ্ছি না। তবে পশ্চিমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে যেকোনো সময় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।’
বিজ্ঞাপন
জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারে একক দেশের হুমকি মোকাবিলায় বিভিন্ন সময়ে একে অন্যকে নিয়ে জোট গঠন করেছে অনেক দেশ। তবে এখন পর্যন্ত বড় কয়েকটি দেশের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে ইউরোপ মনে করে, এই মুহূর্তে রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্র্যান্স টিমারম্যান্স বলেছেন, রাশিয়ার বিকল্প তৈরি করা তাদের জন্য এখনই সহজ হবে না। অন্তত কয়েক বছর লেগে যাবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এটা সহজ হবে না। তবে করা সম্ভব।’
ইউরোপ মূলত এ কারণেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,