ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর ছয় মাস গড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ইউক্রেনীয় বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে একপ্রকার হোঁচট খেয়েছে রুশ বাহিনী। এমনকি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত এই সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
তবে যুদ্ধ শুরুর আগে চিত্রটা ছিল ভিন্ন। পশ্চিমা সমরবিদদের অনেকেরই ধারণা ছিল, যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেনের বিপরীতে রুশ সামরিক বাহিনী বহু এগিয়ে থাকবে। কারণ, তাদের রয়েছে উন্নত প্রশিক্ষণ পাওয়া বিশাল সেনাবহর, আর অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র। পাশাপাশি রাশিয়ার সাইবার সক্ষমতা দেশটির সামরিক বাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, রাশিয়ার সেনাদের অবস্থা ও ইউক্রেনীয়দের রণকৌশলসহ আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে।
যুদ্ধে ভালো করেনি রুশ বাহিনী
যুদ্ধ শুরুর আগে দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল রাশিয়া। অভিযানের প্রথম দিকে বিশাল সামরিক বহর নিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করেন রুশ সেনারা। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যুদ্ধের গতিপথ বদলাতে থাকে।
রাশিয়ার বিমানবাহিনী ইউক্রেনের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান ও ড্রোন হামলার মুখে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনে কী লক্ষ্যে রাশিয়া লড়ছে, তা পরিষ্কারভাবে জানতেন না দেশটির সেনারা। পুরো যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বদানেও ব্যাপক দুর্বলতা দেখা যায়।
শক্ত নেতৃত্বের অভাবের চড়া মূল্যও দিতে হয়েছিল রাশিয়াকে। ইউক্রেনে দেশটির সাঁজোয়া যানের বহর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মুখে পড়ে। এতে একপ্রকার থমকে যায় রাশিয়ার অগ্রগতি। দেশটির সামরিক বাহিনীর ট্যাংক ও অন্য যানগুলোর জ্বালানির মজুত শেষ হয়ে যায়। টান পড়ে সেনাদের খাবার ও গোলাবারুদেও। এতে করে সে সময় রুশ সেনাদের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ ছাড়া ইউক্রেনীয় বাহিনীর কৌশলগত হামলাও রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ভারী করেছিল।
ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর নেতৃত্বের ঘাটতি পূরণে মস্কোর সামরিক বাহিনীর অনেক জেনারেল যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি অবস্থান নেন। তবে বাদ সাধে সামরিক বাহিনীর দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা। এতে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের কাছে এসব জেনারেলের পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়। ফলে তাঁরা হত্যার শিকার হন। এরই মধ্যে বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধের একটি চিত্র উঠে আসে যে, ইউক্রেনে রুশ সেনাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব দেখা গেছে, তাঁরা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ মানছেন না, নিজেদের দখল করা শহরগুলোতে লুটপাট চালাচ্ছেন, হত্যা করছেন বেসামরিক লোকজনকে।
হোঁচট খেয়ে রণকৌশলে বদল আনে রাশিয়া। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে কৌশলী যুদ্ধের দিকে নজর দেয় মস্কো, গ্রহণ করে ধীরে চলো নীতি। ফলে এ অঞ্চলের দোনেৎস্কে সফলতা পায় তারা। দখল করে নেয় গুরুত্বপূর্ণ সেভেরোদোনেৎস্ক শহর। এখন রাশিয়ার নজর ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে।
হাতে যা আছে তাই নিয়ে সর্বোচ্চ লড়ছে ইউক্রেন
রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী তুলনামূলক ছোট হলেও, হাতে থাকা সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তারা। যুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি থমকে দিতে বড় সহায়তা করেছে পশ্চিমা দেশগুলোয় তৈরি কাঁধে বহনযোগ্য ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্কের তৈরি বেরাকতার টিবি-২ ড্রোনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে ইউক্রেনীয়রা। ড্রোনগুলো দিয়ে রুশ লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করার পর সেগুলো দূরপাল্লার কামান দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এতে বড় ধাক্কা খেয়েছে মস্কো।
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার যোদ্ধা ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদেশগুলো। তবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ইউক্রেনকে দেয়নি তারা। কারণ, আশঙ্কা ছিল এর জেরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে রাশিয়া।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে নাড়া দিতে পারলেও, ইউক্রেনীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটাও কম নয়। গত ছয় মাসে দেশটি যে পরিমাণ যোদ্ধা হারিয়েছে, তা পূরণ করা সম্ভব না বললেই চলে। ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের মজুতও আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। দেশটির ভরসা এখন পশ্চিমা অস্ত্রসহায়তা।
যুদ্ধের গতি বদলে দিয়েছে হিমার্স
ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম, যা ‘হিমার্স’ নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাটি কয়েক শ কিলোমিটার দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে পারে। হিমার্স ব্যবহার করে ইউক্রেনে মজুত করা রাশিয়ার অনেক গোলাবারুদ ও গোলাবারুদের ডিপো ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে গোলাবারুদের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে রুশ বাহিনী।
হিমার্স ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের হিসাব–নিকাশ বদলে দিয়েছে বলে মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মিক রায়ান। এই ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাকে ‘গেম চেঞ্জার’ অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মার্ক হের্টলিং। তাঁর মতে, যুদ্ধে ইউক্রেন বাহিনীর সুবিধাজনক অবস্থান পেতে সহায়তা করছে হিমার্স।
অস্ত্রের অভাবে দুই পক্ষই
রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষের জরুরি অস্ত্রগুলোর মজুত কমে এসেছে। রাশিয়ার হাতে বিপুল পরিমাণ কামান ও গোলাবারুদ থাকলেও তা অফুরন্ত নয়। তাদের কাছে থাকা কামানগুলো তৎকালীন সোভিয়েত আমলের। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও ভালোভাবে করা হয়নি। ফলে সেগুলো দিয়ে নির্ভুলভাবে আঘাত হানা যাচ্ছে না। এদিকে রাশিয়া এমন সব ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে, যেগুলো ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের তেমন একটা উপযুক্ত না। অর্থ একটাই, রুশ বাহিনীর হাতে অস্ত্রের মজুত ফুরিয়ে আসছে।
টান পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্রের মজুতেও। সম্প্রতি দেশটির বাহিনী রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়ায় একটি বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। বিষয়টি উদ্ভাবনী হলেও এ ধরনের হামলার জন্য যুদ্ধবিমান ও সামরিক ড্রোন বেশি উপযুক্ত।
যদিও এখনো ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে পশ্চিমারা, তবে তাদের বিপুল চাহিদা মেটাতে গিয়ে চাপে রয়েছে পশ্চিমা অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। পশ্চিমা সামরিক বাহিনীগুলোকে এখন নিজেদের অস্ত্রের মজুতের দিকেও নজর দিতে হচ্ছে। কারণ, এভাবে অস্ত্রসহায়তা চালিয়ে গেলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ বাধলে নিজেদের কাছে এসব অস্ত্রের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছে তারা।
এদিকে ইউক্রেনকে বিপুল অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, দেশটির অর্থনীতি মন্দার দিকে এগোচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির রিপাবলিকান নেতারা ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার পরিমাণ কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিদেশে যুদ্ধের চেয়ে মার্কিনদের ওপর বেশি নজর দিতে বলেছেন।
অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের সংকটের পরও দুই পক্ষই এখন ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে নতুনভাবে নজর দেওয়া শুরু করেছে। এ অঞ্চলের খেরসন শহর এখন তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বেশ গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল ও খেরসন
সমুদ্র ও নদীপথে পরিবহনের জন্য খেরসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। গত মার্চে শহরটি দখলে নেয় রুশ বাহিনী। এরপর শহরটির বাসিন্দাদের মধ্যে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ানোর ব্যাপক চেষ্টা চালানো হয়েছে। অনেক বাসিন্দাকে দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার পাসপোর্ট ও টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সিমকার্ড।
খেরসনের পাশেই নিপার নদী। এই নদীর ওপরে দুটি সেতু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে খেরসনকে যুক্ত করেছে। সেতু দুটি দিয়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ করা হয়। খেরসন শহর ও সেতু দুটি দখলে নেওয়া ইউক্রেনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তারা নিপার নদীর দুই তীরে নিয়ন্ত্রণ পাবে ও বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়াতে পারবে। এ ছাড়া ইউক্রেন সেতুগুলো আয়ত্তে পেলে নিপার নদী থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া উত্তর ক্রিমিয়া খাল বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে। খালটি নোভা কখোভকা শহর থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত।
উত্তর ক্রিমিয়া খালটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে একটি কৌশলগত লক্ষ্য। একসময় খালটি ক্রিমিয়ার ৮৫ শতাংশ পানির জোগান দিত। এই পানি দিয়ে চলত সেখানের চাষাবাদ, মেটানো হতো শিল্পকারখানার পানির চাহিদা। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর পানি বন্ধ করে দেয় ইউক্রেন। তবে বর্তমানে খালটির দুই পাশের অঞ্চলগুলো রাশিয়ার দখলে থাকায় পানি সরবরাহ চালু রয়েছে।
এ ছাড়া রাশিয়া যদি কখনো ওদেসা বন্দর দখলে নিতে চায় ও ইউক্রেনকে সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়, সে ক্ষেত্রেও খেরসন রুশ সামরিক বাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ওদেসা বন্দর দিয়ে ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য রপ্তানি করা হয়।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বেশির ভাগ অঞ্চল এখন রাশিয়ার দখলে। দক্ষিণ ইউক্রেনের বড় অংশও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে রুশ বাহিনী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মস্কোর কাছে ইউক্রেনে ‘জয়লাভের’ অর্থটা কী আর কোথায় গিয়ে এই অভিযানের ইতি টানবে তারা?
***অনুবাদ: শেখ নিয়ামত উল্লাহ
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,