লেখক:জুলিয়া খ্রেবতান।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর লাখ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক প্রাণভয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোও রাশিয়া থেকে বানের পানির মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় আমেরিকান ফাস্ট ফুড করপোরেশন ম্যাকডোনাল্ডসের আট শর বেশি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে মস্কোয় এ রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল দেশটির পশ্চিমাপন্থী নতুন যুগের প্রতীক।
পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবণতার সে যুগ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং রাশিয়ান জাতীয়তাবাদ দ্রুত পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। রাশিয়াকে পশ্চিমাদের প্রত্যাখ্যান এবং ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের সূত্র ধরে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে শ্বাসরোধ করার ফল হিসেবে এ ধরনের জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখা যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে দেশটি চাপে পড়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটাবে—এমন আশাতেই পশ্চিমারা মস্কোর ওপর অবরোধ আরোপ করেছে।
কিন্তু আমরা যারা বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর রাখি, তারা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, যাঁরা মনে করেন এ নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া থমকে যাবে এবং ইউক্রেনে হামলা বন্ধ করবে, তাঁরা রাশিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে খুবই কম জানেন। রাশিয়ানরা অশান্তি ও অস্থিরতায় অভ্যস্ত। বিংশ শতাব্দীতে তাদের নিষ্ঠুর সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহ্য করতে হয়েছিল এবং একবিংশ শতকের প্রথম দিকে তাদের নিজেদেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল।
মিখাইল গর্বাচেভের বিরল উদাহরণ ছাড়া সে সময়কালে রাশিয়ান নেতৃত্ব কখনোই গণতান্ত্রিক ছিল না। একজন দুর্বল জারের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা দেশটি সংঘাতকবলিত দারিদ্র্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে জার শাসনের অবসান হয়েছিল এবং সেটি কয়েক দশক ধরে সোভিয়েত শাসনের সূচনা করেছিল। সোভিয়েত রাষ্ট্রকে দৃঢ় শাসনের আওতায় আনতে ১৯১৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত জনগণকে কঠোর হাতে দমন করা হয়েছিল।
১৯২৯ সালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্ত করা হয় এবং রাজনৈতিক নেতারা সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি নিরঙ্কুশ, নিঃস্বার্থ আনুগত্য প্রদর্শনের আদেশ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ায় শিশুসহ প্রত্যেক নাগরিককে বেদনাদায়ক আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শক্তিক্ষয় করা সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নাগরিকেরা যাতে পশ্চিমে ভ্রমণ ও যখন খুশি তখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে, সে জন্য এক অদৃশ্য রূপক লোহার পর্দা তৈরি করে। সোভিয়েত রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বিশ্ব পরিস্থিতিকে শীতল যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। সেই সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যর্থ কৃষি সংস্কারব্যবস্থা খাদ্য রেশনিং ব্যবস্থার জন্ম দেয়। এরপর ১৯৯০–এর দশকে সোভিয়েত শাসনের বেদনাদায়ক অবসান নবগঠিত রাশিয়ায় বেকারত্ব ও উচ্চ আত্মহত্যার হারসহ নিদারুণ অর্থনৈতিক অশান্তি নিয়ে আসে।
এসব গল্প রাশিয়ায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য সতর্কতামূলক কাহিনি হিসেবে কাজ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ানদের তাদের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করেছিল। এখন তারা রুশদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এটি রুশ ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছেও পশ্চিমকে দুমুখো সাপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। সরকারের কাজের জন্য পশ্চিমারা সাধারণ রুশ নাগরিকদের অর্থনৈতিকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে শাস্তি দিচ্ছে। এতে পশ্চিমাবিদ্বেষ বাড়বে এবং রাশিয়ানদের মধ্যে ঐক্য মজবুত হবে বলে মনে হচ্ছে।
রাশিয়ানদের এ দুঃখের তালিকা আমাদের কী শেখায়? এসব আমাদের এটি শেখায় যে রাশিয়ানরা নিষেধাজ্ঞাজনিত পণ্যের অনুপস্থিতিতে ভয় পাবে না। বিলাসসামগ্রী, আইফোন, নতুন ধরনের কফি এবং বিদেশি গাড়ি গত ২০ বছরে রুশ নাগরিকদের জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু এসব ছাড়া তাদের জীবন তারা কল্পনা করতে পারবে না, এমন অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। ম্যাকডোনাল্ডসের মতো পশ্চিমা ব্যবসাকে রাশিয়ায় একটি বিলাসবহুল ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মস্কো এবং আশপাশের শহরে এ ধরনের রেস্তোরাঁ চললেও আদতে রাশিয়ানদের সিংহভাগ মানুষ এখনো তাদের নিজ নিজ শহরে ম্যাকডোনাল্ডস দেখতে পায়নি।
ঐতিহাসিকভাবে যেকোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম রাশিয়া এবং তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে এসেছে। আর রাশিয়ার শত্রু ঐতিহ্যগতভাবেই পশ্চিমারা। এ বোধ থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং শীতল যুদ্ধ জাতিকে সোভিয়েত পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে এনে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সোভিয়েত পরিচয় বিভিন্ন জাতিসত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে শুধু রাশিয়াই সীমাবদ্ধ নয়। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী ছিল মস্কো এবং সরকারি ভাষা ছিল রুশ। তথাপি সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪টি অতিরিক্ত প্রজাতন্ত্র নিয়ে এ বিশাল দেশটি গঠিত। এ সাম্রাজ্য ১০০টির বেশি জাতীয়তাকে একত্র করেছিল।
আলাদা জাতিগুলোর দাবিকৃত ঐক্য অবশ্য বিতর্কিত। কারণ একতা প্রায়ই জোরপূর্বক তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার এবং সোভিয়েতকরণে সরকারের দিক থেকে জনগণের ওপর বলপ্রয়োগও করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও ‘সোভিয়েত’ বলতে ইউক্রেনীয়, রাশিয়ান, জর্জিয়ান, বেলারুশিয়ান, আর্মেনিয়ান, আজারবাইজানীয়, এস্তোনিয়ানসহ সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী সবাইকে বোঝাত।
বিশ্বের যেখানেই রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ হোক না কেন, সেটা গুরুতর অপরাধ। দ্রুত সেটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে
সোভিয়েত রাশিয়া সব সময় আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা ব্যবহার করত, যা জনগণকে নৈতিক আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করত, যার মূল ছিল রাশিয়া। তখনকার দিনে জনপ্রিয় স্লোগানগুলোর একটি ছিল, ‘প্রথমে মাতৃভূমি নিয়ে ভাবো, এরপর ফুরসত পেলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারো।’ এ কারণে আমরা বিশ্বাস করি, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কৌশল তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
এ কথা সত্য, সব রাশিয়ান ইউক্রেনে চালানো অভিযানে সমর্থন দেন না। কিন্তু রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও সংকটে সব রাশিয়ানকেই ভুগতে হচ্ছে। এ ধরনের অবস্থা তাদের রাগিয়ে দেয়। এতে কেউ কেউ পাল্টা আঘাত করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ রাশিয়ান জাতীয়তাবাদী মানসিকতা সোভিয়েত সময়ে তৈরি করা হলেও সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকেও এ চেতনা প্রভাবিত করছে।
যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ানরা পশ্চিমা ঘরানার বাক্স্বাধীনতা বা অন্যান্য ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে পরিচিত নয়, সে কারণে পশ্চিমা স্বাধীনতার ধারণা তাদের শুধু একটি অংশকে আকর্ষণ করতে পেরেছে। এ কারণে নিজেদের স্বৈরাচারী নেতা নিষ্ঠুরভাবে অন্যায় যুদ্ধ চালালেও তারা প্রায়ই অযৌক্তিকভাবে তাদের নেতাকেই অন্ধ সমর্থন দিতে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, এ অবস্থা রাশিয়ানদের কোথায় নিয়ে ফেলবে?
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি, যে দেশটির ওপর রাশিয়ানরা এখন আগ্রাসন চালাচ্ছে এবং বোমাবর্ষণ করছে, সেই ইউক্রেনও তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এ কারণে সাধারণ রাশিয়ানরা ইউক্রেনবাসীর জন্যও উদ্গ্রীব। কিন্তু পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর যেভাবে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, তাতে পুতিনকে পছন্দ না করা রুশ নাগরিকেরাও পশ্চিমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছে এবং পুতিন সরকারকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে।
আর এটিকেই সম্ভবত পুতিন তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের মেয়াদকে আরও লম্বা করার কাজে ব্যবহার করবেন। তিনি পশ্চিমা অবরোধের মুখে দেশের শিল্প ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কথা বলে দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও উসকে দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যেটি ঘটতে যাচ্ছে তা হলো, রাশিয়ার আবারও একটি সাধারণ শত্রুচক্র থাকবে এবং যেহেতু রাশিয়ায় ভিন্নমত প্রকাশ ও অবাধ্যতামূলকভাবে কাজের ফল হিসেবে সাধারণত কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হয়, সেহেতু পুতিনের বিরুদ্ধে কোনো মত শোনা যাবে না।
পুতিনবিরোধীদের মধ্যে আনা পলিতকোভস্কায়া, আলেকসান্দর লিৎভিনেনকো, বরিস নেমৎসভ, আলেক্সি নাভালনি এবং আরও অনেককে করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। তাঁদের কেউ খুন হয়েছেন, কেউ কারাবন্দী হয়েছেন। এসব গল্প রাশিয়ায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য সতর্কতামূলক কাহিনি হিসেবে কাজ করে। পশ্চিমারা রাশিয়ানদের তাদের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করেছিল। এখন তারা রুশদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এটি রুশ ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছেও পশ্চিমকে দুমুখো সাপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। সরকারের কাজের জন্য পশ্চিমারা সাধারণ রুশ নাগরিকদের অর্থনৈতিকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে শাস্তি দিচ্ছে। এতে পশ্চিমাবিদ্বেষ বাড়বে এবং রাশিয়ানদের মধ্যে ঐক্য মজবুত হবে বলে মনে হচ্ছে।
সাইবেরিয়ায় নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন হলো বাঁচা-মরার বিষয়। নিরাপত্তা নিয়ম না মানলেই সেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। এসব নিয়মের একটি হলো, সব সময় মেরু ভালুককে পালানোর পথ ছেড়ে দিতে হয়। ভালুক কোণঠাসা কিংবা আহত না হলে সাধারণত আক্রমণাত্মক হয় না। অনেক সময় শাবকদের রক্ষা করার জন্যও তারা আক্রমণ করে।
মনে রাখা দরকার, মেরু ভালুক রাশিয়ান জাতিরই প্রতিনিধিত্ব করে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● জুলিয়া খ্রেবতান-হোরহেগার কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্রিটিক্যাল কালচারাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২০, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,