সেকেলে সামরিক সরঞ্জাম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সেনাদের মধ্যে মনোবলের অভাব—জার্মানির সামরিক বাহিনীতে মোটাদাগে এ তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকেরা। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করতে গেলে দেশটিকে আগে এই তিন সমস্যার সমাধান করতে হবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর জার্মান সরকার এসব সমস্যা সমাধান ও সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হয়। এর ঠিক তিন দিন পর জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এক বক্তব্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে ১০ হাজার কোটি ইউরোর বিশেষ বাজেট বরাদ্দের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ২ শতাংশের বেশি বাড়াবে জার্মানি। এ ঘোষণায় বেশ খুশি অস্ত্র উৎপাদন–বিপণন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে খুব একটা মনোযোগ দেয়নি। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার পরও দুটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার জেরে দেশটি নীতিগতভাবে এমন অবস্থান নিয়েছিল। তবে একুশ শতকে এসে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও এর জেরে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জার্মান নীতিনির্ধারকদের সামরিক খাতে আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই সামরিক বাহিনী নিয়ে ঐতিহাসিক নীতিতে পরিবর্তন আনছে দেশটি।
সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পরপর জার্মানির সেনাপ্রধান আলফনস মইস বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদদের একটাই পরামর্শ দিতে পারি, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি সমর্থন কমান। অন্যদিকে জার্মানির প্রতিরক্ষাবিষয়ক কমিশনার ইভা হোগেল সামরিক বাহিনী নিয়ে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছেন, জার্মানির সামরিক বাহিনীর অবস্থা উদ্বেগজনক। তাঁদের এমন মন্তব্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জার্মানির উদারপন্থী ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টির (এফডিপি) সাংসদ ও সামরিক বিশ্লেষক মার্কাস ফাবের বলেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আক্রমণের শিকার হলে জার্মান সামরিক বাহিনী দেশের ন্যূনতম প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না।
সেনা সরঞ্জাম ঘাটতি
জার্মানির নৌবহরের ৩০ শতাংশের কম রণতরি এখন পুরোপুরি কার্যক্ষম। দেশটির অনেক যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের সক্ষমতা হারিয়েছে। জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে ৩৫০টি পুমা কমব্যাট (পদাতিক যুদ্ধযান) রয়েছে। বর্তমানে এর মধ্যে মাত্র ৪০টি সচল রয়েছে। গত ডিসেম্বের প্রকাশিত জার্মান সামরিক বাহিনীর এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জার্মান সেনার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ১৯৯০ সালে দেশটিতে সেনাসংখ্যা ছিল ৫ লাখ। বর্তমানে তা ১ লাখ ৮০ হাজারে নেমেছে। আগ্রাসন প্রতিরোধে সেনার এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলে মত বিশ্লেষকদের।
তাই জার্মান সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো ও আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি। ইভা হোগেলের মতে, ‘শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক পরিকল্পনা ও নিয়োগকাঠামো গড়ে তোলা। তবেই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে।’ প্রতিবেদনে তিনি আরও জানান, ব্যারাকগুলোর অবকাঠামোগত আধুনিকায়নে দুই দশকের বেশি সময় লেগেছে। এমন নীতিগত সময়ক্ষেপণ সেনাদের মনোবল ভেঙে দেয়। তাঁদের হতাশ করে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক। জার্মানির কেন্দ্রীয় ক্রয়বিষয়ক দপ্তরে প্রায় ১০ হাজার কর্মী রয়েছেন। এরপরও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে অনেক সময় লাগে। মার্কাস ফাবেরের মতে, ছোট একটি ক্রয়প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও বছরখানেক সময় লেগে যায়। জার্মান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য আধুনিক ও নতুন মডেলের রাইফেল কেনার প্রকল্পটি এখনো ঝুলে রয়েছে। এসব সমস্যা জিইয়ে রেখেই জার্মান সরকার সামরিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পথে হাঁটছে।
কেনা হচ্ছে অস্ত্র সরঞ্জাম
পুরোনো টর্নেডো যুদ্ধবিমান বদলে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে লকহিড মার্টিনের অত্যাধুনিক এফ–৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান কিনছে দেশটি। এতে ব্যয় হবে প্রায় ১০ কোটি ইউরো। এ ছাড়া ইউরো ফাইটার যুদ্ধবিমান ও ইসরায়েলের কাছ থেকে সশস্ত্র ড্রোন কিনতে চাইছে জার্মানি। তবে ইউক্রেনে রুশ হামলার আগপর্যন্ত জার্মানির ক্ষমতাসীন দলের জোট সদস্যরা এ উদ্যোগে সায় দেননি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারেন।
ইসরায়েলের কাছ থেকে ২২০ কোটি ডলার ব্যয়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘অ্যারো–৩’ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে জার্মানি। ২০২৫ সাল নাগাদ এ ব্যবস্থা জার্মানিতে স্থাপন করার কথা রয়েছে। জার্মানির অন্তত তিনটি জায়গায় এর রাডার বসানো হবে। ফলে আকাশপথে যেকোনো হামলার বিষয়ে সার্বক্ষণিক বার্তা পাবে দেশটি। আগাম সতর্ক হতে পারবে। সম্ভাব্য হামলার আগেই আকাশে রকেট–ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা সম্ভব হবে। পরিবহন হেলিকপ্টার বহরে আমেরিকান চিনুক হেলিকপ্টার যুক্ত করছে জার্মানি। মার্কাস ফাবেরের মতে, চলমান ক্রয়প্রক্রিয়াগুলো শেষ করতে আরও আট বছর সময় লাগবে।
তবে জার্মানিতে সবার অবস্থান সামরিকায়নের পক্ষে নয়। অনেকেই এর বিরোধিতা করছেন। গত সপ্তাহে একটি অনলাইন আবেদনে শিল্পী, রাজনীতিক, ধর্মীয় নেতাসহ প্রায় ৬০০ ব্যক্তি সই করেছেন। ওই আবেদনে ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতার’ সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সামরিক খাতে বাড়তি ব্যয় জার্মানির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য অন্যান্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কমানোর কারণ হতে পারে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২৯, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,