ইউক্রেনে ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ বাহিনী হামলার পর থেকেই বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ছে। হামলা ঠেকাতে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করছে। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই পথে হেঁটেছে যুক্তরাজ্যও। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তারাও রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খবর আল–জাজিরার
বিপি স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ অব ওয়ার্ল্ড এনার্জি ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৮২২ বিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করেছে বিশ্ব। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই ব্যবহার করেছে ২০ শতাংশের বেশি গ্যাস। দেশটির গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ৮৩২ বিলিয়ন ঘনফুট। এরপর গ্যাস ব্যবহার করেছে যথাক্রমে রাশিয়া ৪১১ বিলিয়ন ঘনফুট ও চীন ৩৩০ বিলিয়ন ঘনফুট।
বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভের শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া, এরপরেই ইরান ও কাতার। ২০২০ সালে বিশ্বে ব্যবহৃত গ্যাসের অর্ধেকই সরবরাহ করেছে এই তিন দেশ। বর্তমানে রাশিয়ায় ৪৮ হাজার ৯৩৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে। এরপরেই রয়েছে ইরানে ৩৪ হাজার ৭৭ বিলিয়ন ঘনফুট এবং কাতারে ২৩ হাজার ৮৩১ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
কোন দেশ সবচেয়ে বেশি গ্যাস রপ্তানি করে
শীর্ষ তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের জোট (ওপেক) ছাড়া বিশ্ব বাজারে গ্যাস সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার আর কোনো বড় বহুজাতিক সংগঠন নেই, যারা তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলতে পারে। এর বাইরে গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোটে (জিইসিএফ) ১১টি দেশ রয়েছে। দেশগুলো হলো আলজেরিয়া, বলিভিয়া, মিসর, নিরক্ষীয় গিনি, ইরান, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো এবং ভেনেজুয়েলা।
সদস্যদেশগুলো ছাড়া আরও ৮টি দেশ সংগঠনটির পর্যবেক্ষক। দেশগুলো হলো অ্যাঙ্গোলা, আজারবাইজান, ইরাক, মালয়েশিয়া, মোজাম্বিক, নরওয়ে, পেরু এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলো বিশ্বে ব্যবহৃত প্রায় ৭১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করে।
অপর দিকে বিশ্বে গ্যাস রপ্তানির মোট ৮০ শতাংশই জোগান দেয় ১০টি দেশ। ২০২০ সালে শীর্ষ ১০ গ্যাস রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষ রয়েছে রাশিয়া। দেশটি ১ লাখ ৯৯ হাজার ৯২৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রপ্তানি করেছে, এরপরে যুক্তরাষ্ট্র ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট, অস্ট্রেলিয়া ১ লাখ ২ হাজার ৫৬২ মিলিয়ন ঘনফুট, কানাডা ৭০ হাজার ৯৩২ মিলিয়ন ঘনফুট, জার্মানি ৫০ হাজার ৯২ মিলিয়ন ঘনফুট, নেদারল্যান্ডস ৩৯ হাজার ৯৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট, আলজেরিয়া ৩৪ হাজার ৪৫৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং নাইজেরিয়া ৩৫ হাজার ৫৮৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রপ্তানি করেছে।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর কোন দেশ কতটা নির্ভরশীল
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ইতালি প্রয়োজনীয় এক-চতুর্থাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে। এতে দেশটির খরচ হয়েছে ৫৮০ কোটি ডলার। ইতালির গ্যাস আমদানির প্রায় ৩৯ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে।
২০১৯ সালে বিশ্বের অন্তত ৩৭টি দেশ রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করেছে। রুশ গ্যাসের ওপর সবচেয়ে নির্ভরশীল দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বেলারুশ, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, নরওয়ে ও সার্বিয়া। এসব দেশ তাদের চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপ কতটা নির্ভরশীল
যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ গ্যাস সঞ্চালন লাইন রাশিয়ার। দেশটিতে প্রায় এক লাখ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস সঞ্চালন লাইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস আমদানি করেছে ইউরোপ, যা বছরে ১৪০ বিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ঘনফুট রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসও (এলএনজি) রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো রাশিয়া থেকে প্রায় ৪৫ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে, যা দেশটির মোট গ্যাস ব্যবহারের প্রায় ৪০ শতাংশ।
সম্প্রতি জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে একটি কৌশলগত ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০২২ সালের মধ্যে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর থেকে দুই-তৃতীয়াংশ নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চায় তারা। একই সঙ্গে বিকল্প গ্যাস সরবরাহ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হবে ভোক্তাদের। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে জ্বালানির খরচ বেড়ে গেছে। সেখানে পেট্রল ও ডিজেলের দামও বেড়ে গেছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে দাম আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রলের দাম ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে সেখানে পেট্রলের দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া তেল ও গ্যাস বন্ধ করলে ইউরোপকে ‘রেশনিং ব্যবস্থা’র মতো পথে হাঁটতে হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,