লেখক:সুশান্ত মল্লিক ও ব্রিগিট গ্রানভিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২২ সালের সবচেয়ে উদ্ধৃতযোগ্য মন্তব্যের জন্য যদি পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেই দৌড়ে একেবারে সামনের কাতারে থাকবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস কে জয়শঙ্কর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত। এর প্রতিক্রিয়ায় গত জুন মাসে স্লোভাকিয়ায় নিরাপত্তা ফোরামের এক বক্তৃতায় জয়শঙ্কর বলেন, ‘ইউরোপীয়রা এমন এক মনোভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠেছেন যে তাঁরা মনে করেন, ইউরোপের সমস্যাই বিশ্বের সমস্যা, কিন্তু বিশ্বের সমস্যা ইউরোপের সমস্যা নয়।’
অন্যান্য প্রধান সমস্যার মতো যুদ্ধও আমাদের যুগের সব আলোর ওপর ছায়া ফেলেছে। তবে এ যুদ্ধ নিয়ে ভারতের অবস্থান আলোকবর্তিকার মতোই। ইউক্রেন ঘিরে সংঘাত বিশ্বে বি-বিশ্বায়নের প্রবণতা কতটা প্রবল করেছে, ভারতের বর্তমান বিদেশনীতি তার একটা দৃষ্টান্তমাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা বনাম চীন ও এর প্রধান উপগ্রহ রাশিয়া—বিশ্ব প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত। এ রকম দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে ভারত ‘কৌশলগত স্বাধিকার’-এর ওপর জোর দিয়ে আসছে। ভারতের বর্তমান অবস্থান এ নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। এর সারমর্ম হলো, ভারত একটি আত্মনির্ভরশীল ও বহুমাত্রিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এর অর্থ হলো, দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধের নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখা এবং বিশ্বপরিসরে বহুমাত্রিক সম্পর্কের মাধ্যমে সুবিধা আদায় করে নেওয়া।
ইউরোপের রাজনীতিকেরা এখন রাশিয়ার জ্বালানি থেকে নির্ভরতা কমাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়ার তেলের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে। এ অবস্থায় মস্কো থেকে বেশি বেশি তেল কিনছে ভারত। এ কারণে তাঁরা ভারতকে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, জুলাইয়ের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে গড়ে প্রতিদিন ১১ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনেছে ভারত। দেশটির মোট জ্বালানি তেলের ৫ ভাগের ১ ভাগ এখন আসছে রাশিয়া থেকে। গত বছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে ভারত সরকারের কূটনৈতিক অবস্থান হলো, রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সত্ত্বেও ইউরোপ মস্কোর সঙ্গে যে পরিমাণ জ্বালানি-বাণিজ্য করছে, তার তুলনায় ভারতের বাণিজ্য একেবারেই কম। এ বক্তব্যকে আরেকটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। রাশিয়ার সস্তা তেল কেনার মধ্য দিয়ে ভারত সম্ভবত ইউরোপকে আরও বড় ধরনের অর্থনৈতিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। গত বছর রাশিয়া পশ্চিমাদের কাছে প্রতিদিন গড়ে ৪৩ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল (পরিশোধিত-অপরিশোধিত মিলিয়ে ৬০ লাখ ব্যারেল) বিক্রি করেছিল। এ কারণে রাশিয়া এবার তেল বিক্রির জন্য ভারতের মতো বিকল্প বাজার না পেলে বিশ্বে তেলের দাম আরও বাড়ত।
রাশিয়ার জ্বালানি তেল বাজারে থাকার গুরুত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে শিল্পোন্নত জি-৭ জোটের সম্মেলনে। তবে জি-৭-এর নেতারা বিকল্প একটা নিষেধাজ্ঞা কৌশল প্রণয়নের চেষ্টা করছেন, যেটা ভারতকে বড় ধরনের পরীক্ষার মুখে ফেলে দেবে। প্রথম পরিকল্পনায় রয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যেই রাশিয়া থেকে সরাসরি তেল আমদানির ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। একই সঙ্গে বিশ্বের সমুদ্র ইনস্যুরেন্স বাজারে পশ্চিমা (বিশেষ করে ব্রিটিশদের) যে আধিপত্য, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে রাশিয়ার তেল রপ্তানির প্রচেষ্টা বন্ধ করা।
দ্বিতীয় পরিকল্পনা হলো, তথাকথিত ‘প্রাইস ক্যাপ’ (দাম বেঁধে দেওয়া) কৌশল। এর মাধ্যমে রাশিয়াকে তেল বিক্রি করতে দেওয়া হবে, কিন্তু এমন একটা দর নির্ধারণ করে দেওয়া হবে, যাতে শুধু উৎপাদন খরচটা উঠে আসে। এর উদ্দেশ্য হলো, তেল বিক্রির মুনাফা রাশিয়া যাতে যুদ্ধ-অর্থনীতিতে ব্যবহার করতে না পারে।
জুন মাসে জি-৭ সম্মেলনে প্রথম যখন প্রাইস ক্যাপ বসানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়, সে সময়ে কয়েকজন নেতা, বিশেষ করে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এ প্রস্তাবের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তৃতীয় কোনো পক্ষ রাশিয়ার তেল কিনলে যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গ তোলেন তিনি। আবার ধরে নেওয়া যাক, রাশিয়া প্রাইস ক্যাপে তেল বিক্রিতে সম্মত হলো। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে, কোন কোন দেশ রাশিয়ার সস্তা দরের তেল কেনার সুযোগ পাবে এবং কোন কোন দেশ পুরো বাজারদরে কিনবে?
যাহোক, এ ক্ষেত্রে ভারত একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার তেল বিক্রির বিষয়টিতে অস্বচ্ছতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ভারত কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। সস্তা দামে রাশিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল ভারত আমদানি করতে পারে। এ ধরনের আমদানি যদিও রাশিয়ার তেলের দাম চেপে ধরার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের পদক্ষেপ দুর্বল করে দেবে। তা সত্ত্বেও ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ কম।
কেননা, রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার কারণে বর্তমান বাইডেন প্রশাসন এবং পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর সম্পূরক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এর কারণ খুব পরিষ্কার: আমেরিকার চীন নীতির ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে চীনের উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদেশ জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক নিরাপত্তা জোট কোয়াড গঠন করেছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত এই জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে কোয়াডের অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়বে।
হিমালয়ের বিরোধপূর্ণ সীমানায় ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা বিবেচনায় নিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অবশ্যই পারস্পরিক। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে চীনের যে মৈত্রী, সেটাও কৌশলগত বিবেচনায় ভারতের জন্য বড় একটা ভয়ের কারণ। তেল ও অস্ত্র কেনার সুযোগের বাইরের বিষয় এটি। ভারত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কিন্তু রাশিয়া-চীন মিলে উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করুক, সেটা চায় না ভারত।
ভারত সব পক্ষের সঙ্গেই খুব নিপুণভাবে খেলতে পারছে। রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনেছে ভারত। ২০৩১ সালে পর্যন্ত রাশিয়ান অস্ত্র উৎপাদনের চুক্তিও দিল্লি করেছে। আবার ন্যাটোর সদস্য, বিশেষ করে ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ায় শিল্পকারখানার কাঁচামালের জোগান বাড়িয়েছে ভারত।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দেশটির বহুমুখী বিদেশনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপন করছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতের এই ভূরাজনৈতিক স্বাধিকার একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
****সুশান্ত মল্লিক লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধ্যাপক
ব্রিগিট গ্রানভিল লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,