লেখক:মাসুদ মিলাদ এবং শুভংকর কর্মকার
রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন কার্যত বন্ধ। রপ্তানি করা পোশাকের মূল্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় দেশের রপ্তানিকারকেরা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেরিয়েন শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) ১ মার্চ থেকে রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর একই পদক্ষেপ নেয় ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক, জার্মানিভিত্তিক হ্যাপাগ লয়েড এবং সিঙ্গাপুর-জাপানভিত্তিক ওয়ান লাইন। অন্য শিপিং কোম্পানিগুলো এখনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তবে তারা এখন পণ্যের বুকিং নিতে চাইছে না।
এই জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পণ্য পরিবহনে অনীহা দেখানোয় বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। কারও কারও পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে। কারও কারও পণ্য কারখানায় তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য তাঁরা কীভাবে পাঠাবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের যেসব রপ্তানিকারক সম্প্রতি রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি করেছেন, এখনো মূল্য বুঝে পাননি, তাঁরাও উদ্বেগে। কারণ, তাঁদের টাকা আটকে গেছে। সার্বিকভাবে অর্থের পরিমাণ ও রাশিয়া থেকে রপ্তানি আয় অত বেশি নয়, তবে একেকটি কারখানার জন্য এই আটকে যাওয়াটা বড় সংকটের।
যেমন দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তুসুকা গ্রুপের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল প্রথম আলোকে বলছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের ১০ থেকে ১৫ লাখ ডলার আটকে গেলেই তাদের জন্য ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।
■ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ায় পণ্য নেওয়া বন্ধ ঘোষণা করেছে। ■ চট্টগ্রামে ডিপোতে আটকা পড়েছে ১৬৬ কনটেইনার পণ্য।
রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি নিয়ে এই বিপত্তি ও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় তাদের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফটের মাধ্যমে রাশিয়ার ১২টি ও বেলারুশের ২টি ব্যাংককের লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা কার্যকর হবে ১২ মার্চ। রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে বার্তা পাঠিয়ে আপাতত লেনদেন করতে মানা করা হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে।
বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়ার সঙ্গে ১১৪ কোটি ডলারের বাণিজ্য করেছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয় ৫৯ কোটি ডলারের।
কারখানার মালিকেরা বিপদে
গ্রিন লাইফ নিটটেক্স নামের একটি পোশাক কারখানা গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায় ২ লাখ ৩৫ হাজার ডলারের (প্রায় ২ কোটি টাকা) টি-শার্ট, সোয়েট শার্টসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক রপ্তানি করে। রপ্তানির চালান পাঠানোর পর তারা রাশিয়ার ক্রেতার অনুমোদিত আলফা ব্যাংক অব রাশিয়ায় প্রয়োজনীয় নথি পাঠাতে পারছে না। কারণ, বৈশ্বিক কুরিয়ার কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় পাঠানোর জন্য পণ্য নিচ্ছে না। এই অনিশ্চয়তায় রাশিয়ার ২ লাখ ডলারের একটি ক্রয়াদেশের পণ্য তৈরি করার কাজ পিছিয়ে দিয়েছে গ্রিন লাইফ নিটটেক্স।
জানতে চাইলে কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিম বিশ্বাস গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়ার ক্রেতা আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তবে চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য তৈরি করা এক-দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
দেশের মোট পোশাক রপ্তানির পৌনে ২ শতাংশের গন্তব্য রাশিয়া। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৯৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে রাশিয়ায় গেছে ৪২ কোটি ডলারের পোশাক।
রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি নিয়ে এই বিপত্তি ও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় তাদের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফটের মাধ্যমে রাশিয়ার ১২টি ও বেলারুশের ২টি ব্যাংককের লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা কার্যকর হবে ১২ মার্চ। রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে বার্তা পাঠিয়ে আপাতত লেনদেন করতে মানা করা হয়েছে।
তুসুকা গ্রুপ রাশিয়ায় সরাসরি প্রায় ৬ লাখ ডলার ও পোল্যান্ডের মাধ্যমে ৩ লাখ ২১ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানি করে অর্থ পাচ্ছে না। বর্তমানে ২৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পোশাক তুসুকার কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে, যা রাশিয়ায় যাওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠানটি বছরে রাশিয়ায় প্রায় ৬০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।
তুসুকার চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলমান ক্রয়াদেশ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।’
এদিকে এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্সের মতো পোশাকের বিশ্বখ্যাত খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড রাশিয়ায় তাদের বিক্রি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। দেশটিতে এইচঅ্যান্ডএমের ১৫০টির বেশি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। রাশিয়ায় ইন্ডিটেক্সের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫০২। এই দুটি ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পোশাকের বড় ক্রেতার মধ্যে অন্যতম।
রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এইচঅ্যান্ডএম, জারার মতো ব্র্যান্ড রাশিয়ায় সাময়িকভাবে ব্যবসা স্থগিত করায় বাংলাদেশে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়ায় রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের অর্থ আটকে গেছে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। সুইফট থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করায় অর্থ পেতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। রাশিয়ার ক্রেতারা বিকল্প মাধ্যম খুঁজছেন, কারণ তাঁদের দেশে তো যুদ্ধ নেই। তাঁদের তো ব্যবসা করতে হবে।
বন্দরে আটকে পণ্য
জাহাজ কোম্পানিগুলো পণ্য বুকিং নেওয়া বন্ধ ঘোষণা করার পর চট্টগ্রামের বেসরকারি ১৯টি কনটেইনার ডিপোতে রাশিয়াগামী রপ্তানি পণ্যের চালান আটকে গেছে। গতকাল পর্যন্ত ৯টি ডিপোতে ১৬৬ কনটেইনার পণ্য আটকে ছিল। এসব চালান বুকিং বন্ধ ঘোষণার আগেই ডিপোতে নেওয়া হয়েছিল। আবার কনটেইনারে বোঝাই হয়নি এমন পণ্যও ডিপোর ছাউনিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধ ঘোষণার আগে যেসব রপ্তানি চালান ডিপোতে আনা হয়, সেগুলোই মূলত আটকে আছে। বুকিং না পেলে সেগুলো ডিপোতে আসবে না। কারখানায় থাকবে।
স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর অথবা কলম্বোর বন্দর হয়ে ও ইউরোপের বন্দর ঘুরে রাশিয়ায় পণ্য নেওয়া হয়। আবার ইউরোপের বন্দরে নামানোর পর সড়কপথেও পণ্য রাশিয়ায় যায়। রাশিয়ায় পণ্য নিতে না পেরে এখন ইউরোপ ও আশপাশের দেশগুলোতে নেওয়ার বিকল্প চেষ্টা শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের ঘোসাইলডাঙ্গার সনেট টেক্সটাইল লিমিটেডের একটি চালান গত সপ্তাহে জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক গাজী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত পোল্যান্ডে চালানটি নেওয়া হচ্ছে। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন সচল রাখতে পরামর্শ দিচ্ছে।
অবশ্য যতই নিশ্চয়তা দেওয়া হোক, রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তা কাটছে না।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,