তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) নিয়ে একটি বড় চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গ্যাস পেতে ইউরোপের রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ। এই চুক্তির আওতায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ইইউকে অন্তত দেড় হাজার কোটি ঘনমিটার এলএনজি গ্যাস অতিরিক্ত সরবরাহ করবে।
আজ বিবিসির খবরে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির ইউরোপের মিত্র দেশগুলো। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহৃত রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলো যাতে সংকট না পড়ে, সেই তৎপরতা রজায় রয়েছে।
ইইউভুক্ত দেশগুলো তাদের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে থাকে রাশিয়া থেকে। এর পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার ৬০০ কোটি ঘনমিটার। যুক্তরাজ্যের বিজনেস, এনার্জি ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্র্যাটেজি–বিষয়ক দপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫৪ হাজার ১০০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ায় হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইতিমধ্যে রাশিয়া গ্যাস আমদানি কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এ জন্য আমদানি বাড়ানো এবং আরও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তিন দিনের ইউরোপ সফরকালে স্থানীয় সময় শুক্রবার এ ঘোষণা এল। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন বাইডেন। ওই সম্মেলনের পর রাশিয়াকে মোকাবিলায় পূর্ব ইউরোপে আরও বেশি সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেন জোটের নেতারা।
বাইডেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা নিয়ে বৈঠক করেছেন এবং কিয়েভকে আরও সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও জলপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রাশিয়ার সেনারা
নতুন গ্যাস চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো, অন্তত ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার কোটি ঘনমিটার মার্কিন গ্যাস ইইউতে সরবরাহ নিশ্চিত করা। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০০ কোটি ঘনমিটার।
ব্রাসেলসে সাংবাদিকদের বাইডেন বলেন, ‘পুতিন প্রতিবেশীদের চাপে রাখতে তাঁর জ্বালানি শক্তিকে ব্যবহার করছেন। আর এই চাপকে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কাজে লাগাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, এই চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি সুফল রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি কমানোর কারণে সৃষ্ট ক্ষণস্থায়ী দুর্ভোগ লাঘবে অনেক বেশি কাজে দেবে। বাইডেন আরও বলেন, ‘আমি জানি, রাশিয়ার গ্যাস ব্যবহার না করার কারণে ইউরোপের ব্যয় বাড়বে। তবে এটি (চুক্তি) শুধু নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে করা তা নয়, এটি আমাদের কৌশলগত ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করবে।’
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, ‘ইউরোপীয় হিসেবে আমরা রাশিয়া থেকে দূরে থাকা সরবরাহকারীদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে চাই, যাদের আমরা বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য বলে মনে করি। আমরা রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প খোঁজার সঠিক পথে আছি।’
তবে যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপের চাহিদা মেটাতে পারবে? বিবিসি নিউজের অনলাইন ইউরোপ এডিটর পল কিরবি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তিনি তুলে ধরেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি বড় চুক্তির ঘোষণা কিছু সময় আগে জানা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপক বাড়ালেও, ইইউভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্রের জন্য এটি সামান্য মাত্র।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে হলে এবং এ বছরের গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্যে সফল হতে হলে ইইউকে বিকল্প অন্য দেশের দ্বারস্থ হতে হবে।
গত বছর ইইউ রাশিয়া থেকে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করে, যা তাদের মোট আমদানির ৪০ শতাংশ। জার্মানি একাই তাদের চাহিদার ৫৫ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করতে নর্ড স্ট্রিম–২ নামের নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন জার্মানি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু তা ইতিমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে।
রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করতে নর্ড স্ট্রিম–২ নামের নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন জার্মানি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু তা ইতিমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে
রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করতে নর্ড স্ট্রিম–২ নামের নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন জার্মানি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু তা ইতিমধ্যে স্থগিত করা হয়েছেফাইল ছবি: রয়টার্স
গত বছর ইইউ জানায়, তারা তরলীকৃত গ্যাসের প্রায় এক–চতুর্থাংশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছে। তাই এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আরও দেড় হাজার কোটি ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে এ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নও ওঠবে। কাতার ও রাশিয়া বৃহৎ গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। আর কাতার জানিয়েছে, তারা ইউরোপে বেশি গ্যাস দিতে পারবে না। এ ছাড়া ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনালগুলোর ক্ষমতা সীমিতও।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২৪টি বড় ধরনের টার্মিনাল রয়েছে, যা আমদানি করা তরল গ্যাসের পুনরায় প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য অপরিহার্য। স্পেনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে, তবে ইউরোপের বাকি অংশে সীমিত পাইপলাইন রয়েছে। জার্মানি এলএনজি সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও বিকল্প খুঁজছে। ইতিমধ্যে দেশটি পরবর্তী শীতের জন্য সময়মতো চালানের জন্য নরওয়ের সঙ্গে কথাও বলছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,