লেখক: ম্যাকিয়েজ কিসোলোস্কি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পশ্চিমা নেতারা অন্যান্য স্বৈরাচারী শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার দিকে ঝুঁকেছেন বলে মনে হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৬ মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে আমরা সৌদি আরব সফর করে সেখানকার অঘোষিত শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করতে দেখলাম। তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর হাতে গোনা যে কয়জন পশ্চিমা নেতা সৌদি সফর করেছেন, জনসন তাঁদের তালিকায় যুক্ত হলেন।
রাশিয়ান তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং বিকল্প উৎস খোঁজার অভিপ্রায়ে এর আগে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের লাতিন আমেরিকা বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা হুয়ান গঞ্জালেজ যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদেশ হিসেবে পরিচিত ভেনেজুয়েলায় গিয়ে সেখানকার নিকোলা মাদুরোর কর্তৃত্ববাদী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ন্যাটোর সদস্য হয়েও যে তুরস্কে গণতন্ত্রের মান শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, বেকায়দায় পড়ে সেই তুরস্কের ওপরও যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদের হাত পড়েছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতা করছে কর্তৃত্ববাদী এরদোয়ানের তুরস্ক।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে চমকে দেওয়া বিষয় হলো, পোল্যান্ডের অনুদার সরকারকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর বড় ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। পোল্যান্ডের ডি ফ্যাক্টো নেতা ল অ্যান্ড জাস্টিস (পিআইএস) পার্টির নেতা জারোস্লাভ কাচজিনস্কি সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত কিয়েভে পরিদর্শন করা পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভেনিয়ার সরকারি নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনাম দখল করেছেন এবং সেখানে তাঁর ‘সাহসী দেহভাষা’ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিতও হয়েছে।
তুরস্ক ১০ বছর ধরে বিপুল শরণার্থী সামাল দিয়ে আসছে, যা ইউরোপের জন্য অনুসরণীয়
সেখানে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের পক্ষে কাচজিনস্কি যেসব কথা বলছেন তা একেবারেই পরাবাস্তব। কারণ তিনি এমন একজন লোক যিনি ১৯৮৯ সাল থেকে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে কাজ করে এসেছেন। গত সাত বছরে কাচজিনস্কি তাঁর শাসনামলে পোল্যান্ডকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের গণতান্ত্রিক অগ্রগামী একটি দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ‘স্বৈরাচারী’ দেশে পরিণত করেছেন।
পোল্যান্ডের ওপর পশ্চিমের এই নতুন নির্ভরতা ২০১৫ সালের শরণার্থী সংকটের সময় তুরস্কের ওপর তার নির্ভরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ওই সময় পশ্চিমাদের কাছ থেকে ৬৬০ কোটি ডলারের বিনিময়ে সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের ইউরোপে যাওয়া ঠেকাতে সম্মত হয়েছিলেন। আর এখন কাচজিনস্কি ঠিক একই কায়দায় ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে আরও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ নিচ্ছেন।
এসবের অন্তর্নিহিত কারণ একটাই। সেটি হলো: পশ্চিমের নীতি কথার বাগ্মিতা এবং তারা আসলে যা করতে চায় তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। হাঙ্গেরি আরেকটি আধা-স্বৈরাচারী ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পরিবহনের জন্য দেশটি তার অঞ্চল ব্যবহার করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে। তাদেরও খুশি রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো তোড়জোড় শুরু করেছে। পোলিশ সীমান্তের কাছে একটি সংকীর্ণ সীমান্ত পথ আছে যেখান দিয়ে ইউক্রেনে সহজে সামরিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব।
পোল্যান্ড এই পথ ব্যবহার করতে দেবে। তবে তার জন্য সে চড়া মূল্য নিতে চায়।
২০১৬ সালে যেভাবে শরণার্থীরা তুরস্কের এসে পড়েছিল, ঠিক একইভাবে পোল্যান্ড সরকারও তাদের মাটিতে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের একটি বড় অংশকে আশ্রয় দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তার বিনিময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে মোটা অর্থ আদায় করতে চায় তারা। শরণার্থীর চাপে পশ্চিমের জন্য পোল্যান্ডের অনুগ্রহের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং ইতিমধ্যেই তারা কাচজিনস্কির বিষয়ে সুর নরম করে ফেলেছে। কাচজিনস্কিকে এখন আর তারা আগের মতো স্বৈরশাসক বলে টিপ্পনী কাটে না।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কাচজিনস্কির ‘পুতুল প্রেসিডেন্ট’ আন্দ্রেজ ডুদাকে বলেছেন, ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।’ অর্থাৎ বিপদের মুখে পড়ে কর্তৃত্ববাদী পোল্যান্ড এখন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে গেছে। কমলা হ্যারিসের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে পোল্যান্ডে ট্রাম্পের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জর্জেট মোসবাচার বলেছেন, ‘পোল্যান্ডের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ পোল্যান্ডকে ইইউ তহবিল থেকে অর্থ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। পোল্যান্ড আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে—এমন অভিযোগ তুলে এত দিন এই তহবিল এত দিন ইইউ আটকে রেখেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো সংকটের মুখে পড়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা যদি স্বৈরশাসকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাহলে পশ্চিমাদের গণতান্ত্রিক মর্যাদা অনেক কমে যাবে। একই সঙ্গে এই সব কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা আরও দুর্দমনীয় হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ম্যাকিয়েজ কিসোলোস্কি সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির আইন ও পাবলিক ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২৮, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,