দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রথম কাজ বলে উল্লেখ করেছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ রাতেই তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার কথা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন যে দেশে কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।’
যে সরকার হবে তা মানুষকে রক্ষা করবে, এ কথা বলেন ড. ইউনূস।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ২টা ১০ মিনিটে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে এসব কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, অন্য দুই বাহিনীর প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এরপর তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।
দেশে আসার পথে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুনেছেন যে এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সম্পদ নষ্ট করছে। নিয়ে যাচ্ছে। অফিস–আদালতে আক্রমণ করছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আহমদিয়া—সবার ওপর আক্রমণ হচ্ছে। এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের অংশ, আমাদের বিষয় না। আমাদের কাজ হলো সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটা যদি আমি করতে না পারি, আমার কথা যদি না শোনেন আপনারা, তাহলে আমার প্রয়োজন এখানে নাই। আমাকে বিদায় দেন। আমি আমার কাজে থাকি, সেখানেই ব্যস্ত থাকি। যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে আপনাদেরকে দেখাতে হবে যে আমার কথা আপনারা শোনেন। আমার কথা না শুনলে, আমার কোনো প্রয়োজন নাই। আমার প্রথম কথা হলো আপনারা বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। আপনারা সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন। যাতে ছাত্ররা আমাদেরকে যে পথ দেখায়, সেই পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি।’
বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা—এগুলো অগ্রগতির বড় শত্রু বলেও উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সেই যাত্রার শত্রু। কাজেই শত্রুকে যাতে রোধ করা যায়, তাদেরকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে হোক, আইনশৃঙ্খলার মাধ্যমে হোক। তাকে মেরে–পিটিয়ে করা ঠিক না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন হতে হবে, তাদের হাতে সোপর্দ করলে আমরা নিশ্চিত থাকব, তার একটা বিহিত হবে। এমন হলো আমরা হাতে দিলাম, দুটা টাকা নিয়ে আবার ছেড়ে দিল, এটা যেন আবার না হয়। সেই আস্থা আমাদেরকে আনতে হবে।’
‘সরকার দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে’
শিক্ষার্থীরা যে অর্জন করে নিয়ে এসেছে, এখন তাদেরকে দিয়ে সমস্ত কাঠামো পরিষ্কার করার দায়িত্ব সামনে বলেও উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘সরকার বলে একটা জিনিস আছে, কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে, সরকার একটা দমন–পীড়নের একটা যন্ত্র। যেখানেই সুযোগ পায়, সেখানেই কষ্ট দেওয়া—সকল স্তরে। কিন্তু এটা সরকার হতে পারে না।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে যে আমাকে সাহায্য করবে। আমাকে রক্ষা করবে।’
যে সরকার হবে, সে সরকার মানুষকে রক্ষা করবে বলে উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘মানুষের আস্থাভাজন হবে। কেউ জোর করে বলাবে না যে ভালো। সে নিজে নিজে বিশ্বাস করবে সরকারি লোক আমার লোক। আমাকে রক্ষা করার লোক। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের মধ্যে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে এটাতে।’
‘আজ গৌরবের দিন’
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজকে আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকে নতুন বিজয় দিবসের সৃষ্টি করল, সেটাকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটা সম্ভব করেছে, যে তরুণসমাজ, তাদের প্রতি আমার সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকে ড. ইউনূসকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে যান। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই সমন্বয়কেরাও ড. ইউনূসের পাশে ছিলেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তারা (সমন্বয়ক) আমার পাশে আছে। এরা এই দেশকে রক্ষা করেছে। এ দেশকে নতুনভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছে। পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সে বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে পারে। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই, এগিয়ে যেতে চাই।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে আমাদের। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক! বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তার পর থেকে কোনো যুবক–যুবতী আর হার মানেনি। সামনে এগিয়ে গেছে। বলেছে, যত গুলি মারো, মারতে পারো, আমরা আছি। যার কারণে সারা বাংলাদেশজুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে। যার কারণেই এই বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল।’
‘স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে’
ছাত্র–জনতার আন্দোলনের ফলে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা রক্ষা করতেই হবে বলেও উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘শুধু রক্ষা করা নয়, এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তা নাহলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নাই। এই স্বাধীনতাকে পৌঁছানোই হলো আমাদের শপথ, আমাদের প্রতিজ্ঞা। ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। মানুষ যেন জানে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন, সুযোগের পরিবর্তন। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন। এটা যেন প্রত্যেকে বুঝে নেয়।’
‘পুরোনোদের বাদ দাও, তাঁদের চিন্তায় মুক্তি হবে না’
তরুণসমাজকে বোঝানো যে এই দেশ এখন তাঁদের হাতে বলেও উল্লেখ করেন নোবেল বিজয়ী একমাত্র এই বাংলাদেশি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশ তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তোমরা যেভাবে স্বাধীন করেছ, তোমরা এ দেশকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতেও পারবে। তোমাদের দেখে সারা দুনিয়া শিখবে কীভাবে একটা দেশ একটা তরুণসমাজ পাল্টে ফেলতে পারে।’
তরুণদের উপদেশ দেওয়া প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাদেরকে আমি বারেবারে এমনি উপদেশ দিই যে পুরোনোদের বাদ দাও। তাদের পুরোনো চিন্তা দিয়ে আমাদের মুক্তি হবে না কোনো দিন। সারা দুনিয়ার মধ্যে হবে না, শুধু বাংলাদেশের কথা না। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, যে সৃজনশীলতা আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। সৃজনশীলতা শুধু বই–খাতায় লেখার জিনিস না। এটা প্রকাশ করার জিনিস, স্থাপন করার জিনিস।’
‘বাংলাদেশ একটা বড় পরিবার’
গোটা বাংলাদেশ একটা বড় পরিবার বলেও মনে করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এই পরিবার আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। আমাদের মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, তা সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদেরকে পথে আনতে চাই, যাতে করে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।’
বাংলাদেশ সুন্দর সম্ভাবনাময় একটি দেশ উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সম্ভাবনাগুলোকে আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে, আমাদেরকে জেগে উঠতে হবে। তারাই এই বীজতলা তৈরি করবে। তাদের হাত দিয়েই হবে। তাদের দিকে আমরা তাকাব এবং তাদের নির্দেশমতো আমরা অগ্রসর হব।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা একটা পরিবার। যেন আমাদের গোলযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে, একসাথে চলতে পারি। আমরা ত্বরিতগতিতে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের কামনা।’
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ০৮, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,