যে পৃথিবী সবার
জুডিথ বাটলার একজন মার্কিন দার্শনিক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ইমেরিটাস অধ্যাপক। টাইম ডট কমে সম্প্রতি তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছেন। পড়ুন সেই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত অংশের অনুবাদ।
অনুবাদে: মো. সাইফুল্লাহ
মহামারিকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করি না কেন, আমরা জানি এটি বৈশ্বিক। মহামারি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা সবাই একই পৃথিবীর অংশীদার। একে অপরের প্রতি মানুষের প্রভাব এত তাৎপর্যপূর্ণ, এটি জীবন-মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কারণ, অনেক সম্পদের ওপরই সবার সমান ভাগ নেই। পৃথিবীতে কারও কারও অংশ খুব ক্ষুদ্র, কিংবা হয়তো মিলিয়েই গেছে। এসব বৈষম্যের মুখোমুখি না হয়ে আমরা বৈশ্বিকভাবে মহামারির মোকাবিলা করতে পারব না।
কিছু মানুষ অজ্ঞাতসারেই পৃথিবীর জন্য কাজ করে যায়, করতেই থাকে। তাদের হয়তো সম্পদ নেই, দলিল নেই। জাত-পাত বিবেচনায় আমরা তাদের দূরে ঠেলে দিই, অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করি। তাদের আমরা দরিদ্র বলি, কালো বলি।
অংশীদারত্বের এই পৃথিবীতে সবার ভাগ সমান নয়। ‘সাধারণ’-এর অংশ হওয়া কারও কারও পক্ষে সম্ভব না। কখনো হয়নি, হবেও না। ফরাসি দার্শনিক জক রসিয়ার ভাষায়, ‘তাদের অংশীদারত্ব, যাদের কোনো অংশই নেই।’ আমি শুধু সম্পদের অংশীদারত্বের কথা বলছি না; বলছি আর সবার মতো করে পৃথিবীটাকে নিজের ভাবার কথা, পৃথিবী সবার সমৃদ্ধির জন্যই সৃষ্টি—এ বিশ্বাসের কথা। জাতিগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও প্রগাঢ় ও দৃশ্যমান হয়েছে এ মহামারিতে। একই সঙ্গে পৃথিবীর প্রতি এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধও স্পষ্ট হয়েছে। মরণশীলতা ও পরস্পর নির্ভরশীলতার এক নতুন ধারণা নিয়ে পৃথিবী অগ্রসর হচ্ছে।
এ মহামারির সময় বাতাস, পানি, আশ্রয়, পোশাক ও স্বাস্থ্যসেবা হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দুশ্চিন্তার কারণ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন অনেক আগেই আমাদের এ বার্তা দিয়েছিল। বাসযোগ্য আবাস কোনো ব্যক্তিগত অস্তিত্বের প্রশ্ন নয়। স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয়, নিরাপদ পানির ভাগ কি পৃথিবীর সবাই সমানভাবে পাচ্ছে? মহামারিকালে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এ প্রশ্নকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। সেই সঙ্গে জলবায়ু বিপর্যয় আমাদের জীবনের জন্য কত বড় হুমকি, সেটিও বুঝিয়ে দিয়েছে।
‘প্যানডেমিক’ শব্দটা এসেছে ‘প্যানডেমোস’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘সবাই’, সবার জন্য, কিংবা এমন কিছু, যা মানুষের মাধ্যমে ছড়ায়। ‘ডেমোস’ শব্দের অর্থ হলো সব মানুষ। এখানে ‘সব’ মানে সত্যিকার অর্থেই সব, আপনি যতই তাদের কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে দেন না কেন। সংক্রমণ ও নিরাময়, কষ্ট ও আশা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মৃত্যু—এসবের মধ্য দিয়ে একটি মহামারি সব মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। সীমানা কোনো ভাইরাসকে থামাতে পারে না, কোনো সামাজিক অবস্থানই ভাইরাস থেকে শতভাগ নিরাপদ করতে পারে না।
ক্যামেরুনের দার্শনিক আশিল এমবেমবে বলেছেন, ‘এখনই সময় পৃথিবীটাকে নতুন করে “সবার জন্য” গড়ে তোলা।’ যদি করপোরেট মুনাফা, বেসরকারীকরণ ও উপনিবেশায়নের জন্য আমরা পৃথিবীর সম্পদ লুণ্ঠন করাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিই, তাহলে এমন একটা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাই যায়, যা আমাদের বারবার নিজেদের অহং, পরিচয় ও সীমাবদ্ধ জীবনের ধারণার দিকে ঠেলে দেবে না।
এমবেমবের মতে, এ আন্দোলন হলো ঔপনিবেশিক ধারণা থেকে বের হয়ে আসা। আমরা যদি পৃথিবীর বিনাশ ও পদ্ধতিগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তাহলেই ‘বুক ভরে নিশ্বাস’ নেওয়ার মতো একটা অংশীদারত্বের পৃথিবী পাব। ‘বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া’ কথাটার তাৎপর্য নিশ্চয়ই এখন আমরা সবাই বুঝি।
তারপরও বাসযোগ্য পৃথিবী নির্ভর করে এমন এক সমৃদ্ধ পৃথিবীর ধারণার ওপর, যার কেন্দ্রে মানুষ নেই। মানুষ যেন নির্ভয়ে, দূষণমুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারে, বাঁচতে পারে, আমরা শুধু এ জন্যই দূষণ রুখে দেব না। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে বরং ভাবব, এ পানি বা বাতাসেরও তো জীবন আছে। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: টাইম ডট কম
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,