লেখক:মো. মিন্টু হোসেন।
২০২২ সাল বিদায় নিয়েছে । শুরু হয়েছে ২০২৩। নতুন বছরে কোন প্রযুক্তি উঠে আসবে, আর সেসব প্রযুক্তি আমাদের ডিজিটাল জীবনযাপনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা জেনে রাখা জরুরি।
চলুন জেনে আসি ২০২৩–এ যে ১০ প্রযুক্তি ট্রেন্ড চলতে পারে, সে সম্পর্কে :
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবখানেই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এখন আর কল্পলোকে আটকে নেই। বাস্তব দুনিয়ায় এর ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। ২০২৩ সালেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাস্তব প্রয়োগ দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে উদাহারণ টানা যায় টুইটারের।
প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বদলে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট দিয়ে কাজ চালানোর চিন্তাভাবনা চলছে। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য ও সেবা তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেবে। ইতিমধ্যে খুচরা বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই ধারা চালু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্টিচ ফিক্স’ এমনই একটি প্রতিষ্ঠান। তারা এআই ব্যবহার করে ক্রেতাদের পোশাকের আকার ও পছন্দ সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে।
নতুন বছরে স্পর্শহীন, স্বয়ংক্রিয় কেনাকাটা ও পণ্য সরবরাহের বিষয়টিও বড় ধরনের ট্রেন্ডে পরিণত হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রেতাদের অর্থ পরিশোধ, পণ্য ও সেবা গ্রহণের কাজটি সহজ করে তুলবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাপ্রক্রিয়ার কাজটিও সহজ করবে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই। একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় পণ্য পৌঁছানোর বিষয়টিও সামনে চলে আসবে। তাই রিটেইল খাতের কর্মীদের এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটের সঙ্গে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
“মেটাভার্সের কিছু অংশ আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠবে।”
সঙ্গী হয়ে উঠবে মেটাভার্স
এ বছরের আলোচিত একটি শব্দ ছিল মেটাভার্স। আগামী বছর মেটাভার্স নিয়ে এই আলোচনা আরও বাড়বে। মেটাভার্সের কিছু অংশ আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠবে। এই মেটাভার্স মূলত ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া। এটি এমন ত্রিমাত্রিক ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারেন। প্রত্যেকের ত্রিমাত্রিক অ্যাভাটার বা অবতারের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় পারস্পরিক যোগাযোগ হয়ে থাকে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগামী বছর ইন্টারনেটের আরেক নাম হয়ে উঠতে পারে এই মেটাভার্সের দুনিয়া। এখানে মানুষ কাজ, খেলাধুলা ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ মেটাভার্স বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করবে। ভবিষ্যতে মেটাভার্স কোন পথে যাবে, তার দিকনির্দেশনার বছর হয়ে উঠবে ২০২৩। এর বাইরে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি (এআর) ও ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি (ভিআর) প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে। তবে মেটাভার্সের দুনিয়ায় আগামী বছর একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ কেমন হয়, তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইতিমধ্যে মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া একসঙ্গে মেটাভার্স প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেছে। তাই আশা করা যায়, নতুন বছরে আমরা আরও উন্নত অ্যাভাটার প্রযুক্তি দেখতে পাব। বাস্তব দুনিয়ায় আমরা দেখতে যেমন, ভার্চ্যুয়ালি ঠিক তেমন করে আমাদের অ্যাভাটার গড়ার জন্য নানা প্রযুক্তি চলে আসবে।
“”ব্লকচেইন প্রযুক্তি””
ওয়েব থ্রি প্রযুক্তিতে অগ্রগতি
ওয়েব থ্রি-র মূল ধারণাটি হলো ইন্টারনেটকে সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রীকরণ করা। এ ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। নতুন বছরে অনেকটাই এগিয়ে যাবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিকেন্দ্রীভূত পণ্য ও পরিষেবা তৈরিতে কাজ করবে।
উদাহরণস্বরূপ, এই মুহূর্তে, আমরা ক্লাউডে সবকিছু সংরক্ষণ করছি। কিন্তু যদি আমরা ডেটা স্টোরেজ বিকেন্দ্রীকরণ করি এবং ব্লকচেইন ব্যবহার করে সেই ডেটা এনক্রিপ্ট করি, তবে আমাদের তথ্য একদিকে যেমন নিরাপদ হবে, অন্যদিকে তথ্যে প্রবেশ ও বিশ্লেষণ করার উদ্ভাবনী উপায় তৈরি হবে।
আগামী বছর নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (এনএফটি) আরও ব্যবহারযোগ্য এবং ব্যবহারিক হয়ে উঠবে। অনলাইন দুনিয়ায় এখন এনএফটি নিয়ে ব্যাপক শোরগোল চলছে। বিনিময়যোগ্য ভার্চ্যুয়াল উপাদানগুলোকে এনএফটি বা নন-ফাঞ্জিবল টোকেন বলা হয়। এটা অনেকটা বিটকয়েনের মতো। কেবল পার্থক্য হলো, প্রতিটি এনএফটি অনন্য।
“”থ্রিডি প্রিন্টিং””
ডিজিটাল ও ফিজিক্যাল দুনিয়ার যোগসূত্র
আমরা ইতিমধ্যে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে ডিজিটাল দুনিয়ার যোগসূত্র সৃষ্টির বিষয়টি লক্ষ করছি। ২০২৩ সালেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। এ যোগসূত্রের দুটি উপাদান হচ্ছে ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি ও থ্রিডি প্রিন্টিং। ডিজিটাল টুইন হলো বাস্তব পণ্যগুলোর ভার্চ্যুয়াল সিমুলেশন বা ভার্চ্যুয়াল গঠন, যা নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশে নতুন ধারণা পরীক্ষা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নকশাকারী এবং প্রকৌশলীরা ভার্চ্যুয়াল জগতের অভ্যন্তরে বাস্তব বস্তু পুনরায় তৈরি করতে ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এরপর তা থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে প্রিন্ট করছেন। এতে বাস্তব জীবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কমে আসবে। এ বছর বিভিন্ন কারখানা, যন্ত্রপাতি, গাড়ি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাতে এর ব্যবহার দেখা যাবে।
“”ডিএনএ পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন কাজ করবেন বিজ্ঞানীরা””
জিন এডিটিং
জিন এডিটিং এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। জিনগত সম্পাদনার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতিতে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখন এমন একটি বিশ্বে বাস করছি, যেখানে বিভিন্ন উপাদান, উদ্ভিদ এমনকি মানুষেরও জিনগত সম্পাদনা করে পরিবর্তন আনা সম্ভব। সিআরআইএসপিআর-ক্যাস ৯ নামের প্রযুক্তি কয়েক বছর ধরেই রয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালে আমরা জিনগত সম্পাদনা বা জিন এডিটিংয়ে আরও গতি বাড়তে দেখব।
নতুন বছরে ডিএনএ পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন কাজ করবেন বিজ্ঞানীরা। ডিএনএর নানা সমস্যা সমাধান, খাবারের অ্যালার্জি রোধ, বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মতো নানা কাজ করতে দেখা যাবে তাঁদের। মানুষের চোখের ও চুলের রং পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো জিন এডিটিংয়ের মাধ্যমে করতে দেখা যাবে।
“”কোয়ান্টাম কম্পিউটার””
কোয়ান্টামের অগ্রগতি ও বিপদ বাড়বে
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার খুবই শক্তিশালী, যা আজকের দিনের কম্পিউটারের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারবে। অর্থাৎ এটি দ্রুত অনেক বেশি তথ্য প্রসেস করতে পারবে। এর এলগরিদম, কাঠামো্ব—কিছুই সাধারণ কম্পিউটার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব কম্পিউটার অত্যন্ত জটিল সমস্যা খুবই অল্প সময়ে সমাধান করতে পারবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সম্ভাব্য বিপদ হলো, এটি আমাদের বর্তমান এনক্রিপশন প্রযুক্তিকে অকেজো করে দিতে পারে। তাই কোনো দেশ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিকাশ করে তা অন্য দেশের ব্যবসা, নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং আরও অনেক কিছুর এনক্রিপশন ভেঙে দিতে পারে। ২০২৩ সালে এই ট্রেন্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও রাশিয়া কোয়ান্টাম প্রযুক্তি বিকাশে ব্যাপক অর্থ ঢালছে।
“”হাইড্রোজেন জ্বালানি””
সবুজ প্রযুক্তিতে অগ্রগতি
এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো, আমাদের কার্বন নিঃসরণ কমানো, যাতে আমরা জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে পারি। ২০২৩ সালে সবুজ জ্বালানির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে। বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন জ্বালানি খাতে অগ্রগতি হবে। এ থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
ইউরোপের শেল ও আরডব্লিউই নামের দুটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব জ্বালানির পাইপলাইন স্থাপন করছে। এ ছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ জ্বালানি গ্রিডের দিকেও এগোবে বিশ্ব।
রোবট আরও মানবসদৃশ হবে
২০২৩ সালে রোবট আরও বেশি মানবসদৃশ হয়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে চেহারা ও দক্ষতায় কিছু রোবট মানুষের কাছাকাছি চলে আসতে পারে। এ ধরনের রোবটগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি অভ্যর্থনায়, পানশালা বা বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়্যারহাউস ও কারখানায় বিভিন্ন জটিল কাজ করবে রোবট। সাধারণত মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য ও একঘেয়ে কাজগুলো এ ধরনের রোবট সমাধান করবে।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে টেসলা এআই দিবসে ইলন মাস্ক দুটি অপটিমাস হিউম্যানয়েড রোবট প্রোটোটাইপ দেখিয়ে বলেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁরা রোবটের ফরমাশ নিতে শুরু করবেন। এ ধরনের রোবট বিভিন্ন বস্তু তোলা, গাছে পানি দেওয়ার মতো ঘরের নানা কাজ করতে পারবে।
“”স্বচালিত গাড়ি””
স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমে বড় অগ্রগতি
বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়্যারহাউস ও কারখানা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় নিতে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছেন। ২০২৩ সালেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। স্বচালিত আরও নতুন মডেলের গাড়ি, ট্রাক ও জাহাজ দেখা যাবে নতুন বছরে। অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলোর ব্যবহার শুরু করে দেবে।
কাডো নামের ব্রিটিশ অনলাইন সুপারস্টোর ইতিমধ্যে নিজেদের বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন গ্রোসারি রিটেইলার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, স্বয়ংক্রিয় রোবট দিয়ে তারা গ্রোসারি ব্যবস্থা পরিচালনা করবে।
“”স্মার্টফোন চিপ হবে আরও উন্নত””
টেকসই প্রযুক্তিতে মনোযোগ
নতুন বছরে আরও বেশি টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। এখন অনেকেই স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এগুলো আরও উন্নত হবে।
এর পাশাপাশি এ ধরনের ডিভাইসের যন্ত্রাংশ বা চিপ তৈরির উপাদানগুলোর উৎস দেখবে মানুষ। নেটফ্লিক্স, স্পটিফাইয়ের মতো ক্লাউড সেবার ব্যবহার বাড়বে। এর পেছনে যে বিশাল ডেটা সেন্টার, সেগুলোর জ্বালানি উৎসের টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে অগ্রগতি হবে।
২০২৩ সালে সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতার বিষয়ে মানুষের চিন্তা বাড়বে। তারা টেকসই ও জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তিতে ঝুঁকবে।
****ফোর্বস, এএফপি ও রয়টার্স অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জানুয়ারী ০১, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,