ইউক্রেন যুদ্ধ ২০তম দিনে গড়িয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান ব্যর্থ করে দেওয়ার দাবি করছে কিয়েভ। কিন্তু মস্কো বলছে, ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। সোমবার এক বিবৃতিতে এ দাবি করে রাশিয়ার সরকার। তবে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান ভিক্টর জলোটভ অবশ্য এর আগে বলেছিলেন, ইউক্রেনে যেমন পরিকল্পনা নিয়ে রাশিয়া অভিযান শুরু করেছিল, প্রত্যাশার তুলনায় রুশ অভিযানের গতি কম।
যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। পশ্চিমা অস্ত্র পেয়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধও গড়ে তুলেছে ইউক্রেন। এদিকে সামরিক পরাশক্তি রাশিয়া ইউক্রেনে নিজেদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করছে। বড় শহরগুলোতে হামলা করে কিয়েভে অগ্রসর হচ্ছে রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর শক্তি প্রদর্শন করছেন। বিপরীতে ইউক্রেনীয়রাও দৃঢ়ভাবে এর প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, এমনটা দাবি করছে কিয়েভ। তবে দুই দেশের লড়াই কেমন হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিবদমান পক্ষ কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা জানা প্রয়োজন। আর কে কতটা শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করছে, তার ওপর নির্ভর করছে যুদ্ধে ‘সফল’ হতে যাচ্ছে কারা। যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে, তার ফিরিস্তি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
রাশিয়া যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে
বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার প্রায় ২০ শতাংশই রাশিয়ার। যুদ্ধবিমান, ইঞ্জিন, ক্ষেপণাস্ত্র, সাঁজোয়া যান, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ অনেক ধরনের অস্ত্র বিক্রি করে রাশিয়া। অস্ত্রাগারে থাকা সোভিয়েত আমলের অস্ত্রের আধুনিকায়নও করেছে রাশিয়া। আরও উন্নত অস্ত্র তৈরি ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও জোরদার করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কো মূলত নিজেদের তৈরি অস্ত্র ও অস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করছে। তবে এখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
রাশিয়ার ইসকান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম
রুশ সামরিক বাহিনীর তৈরি ইসকান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম। স্বল্প পাল্লার হলেও রাশিয়ার শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ইসকান্দার নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া কয়েক শ ইসকান্দার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। রাশিয়ার ছোড়া এই ক্ষেপণাস্ত্রের অনেকগুলো ইউক্রেনের বাড়িঘর, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আঘাত হেনেছে এবং এতে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বলে দাবি ইউক্রেনের।
৩এম-১৪ কালিবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র
রাশিয়ার তৈরি এ ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে ভূমিতে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম এ ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ মিসাইল (এলএসিএম)। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ভূমিতে রুশ নৌবাহিনীর হামলার জন্য এটি সবচেয়ে বড় ভরসা।
টিওএস-১ বুরাটিনো
সোভিয়েত আমলে তৈরি রাশিয়ার টিওএস-১ হলো একটি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবস্থা। বুরাটিনো নামের এ অস্ত্র ব্যবস্থা থেকে মূলত আগুনের গোলা বের হয়। এ জন্য এর নাম হেভি ফ্লেমথ্রোয়ার। সর্বোচ্চ ছয় কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আগুনের গোলা দিয়ে এটি মানুষ মারতে পারে। তাতে অনেকগুলো রকেটও থাকে। এর সঙ্গে আরও থাকে থার্মোবারিক ওয়ার হেড। মূলত অক্সিজেন ব্যবহার করে উচ্চমাত্রার বিস্ফোরণে এটি ব্যবহার করা হয়। রাশিয়ার সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্রের মধ্যে টিএওস-১ একটি।
স্থলযুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি টি-৯০ ট্যাংক
টি-৯০ ও টি-৭২বিএম৩ ট্যাংক
যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রধান দুটি ট্যাংক হলো টি-৯০ ও টি-৭২বিএম৩। এর মধ্যে টি-৯০ তৃতীয় প্রজন্মের। সাম্প্রতিক সময়ে টি-৭২বিএম৩-এর আরও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে সম্মুখসমরে এই দুটি ট্যাংক মোতায়েন করেছে রাশিয়া। তবে ইউক্রেনের প্রতিরোধের মুখে তেমন সুবিধা করতে পারছে বলে জানা যাচ্ছে।
ইউক্রেন যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে
রাশিয়ার তুলনায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের সামরিক শক্তি অনেক কম। ইউক্রেনের অস্ত্রাগারে থাকা অস্ত্রের বেশির ভাগ পশ্চিমাদের দেওয়া। এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান শুরুর পর থেকে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো অস্ত্র পাঠিয়েছে। পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো হচ্ছে। মূলত পশ্চিমা দেশের সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়েই সামরিক পরাশক্তি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন ইউক্রেনের সেনারা।
বায়রাক্তার টিবি২ ড্রোন
আকাশপথে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রধান একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার ড্রোন। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে ইউক্রেনের সর্বত্র এ ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক এই ড্রোনকে ‘কিলার ড্রোন’ বলা হয়ে থাকে। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এ ড্রোন ব্যবহার করছে ইউক্রেন।
এফজিএম-১৪৮ ক্ষেপণাস্ত্র
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এফজিএম-১৪৮ জ্যাভেলিন নামে পরিচিত। সর্বোচ্চ চার কিলোমিটার দূর থেকে এটি ট্যাংক ধ্বংস করতে পারে। এখন ইউক্রেনের অস্ত্রাগারে থাকা সবচেয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্রগুলোর মধ্যে জ্যাভেলিন একটি। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এটি রুশ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করে দিতে পারে।
এনএলএডব্লিউ
নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি-ট্যাংক উইপন বা এনএলএডব্লিউ হালকা বহনযোগ্য ট্যাংক বিধ্বংসী একটি অস্ত্র। সর্বোচ্চ ৮০০ মিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এটি। মূলত পদাতিক বাহিনী যাতে প্রতিপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করে সামনে এগোতে পারে, এমন লক্ষ্য থেকে এটি তৈরি করা হয়েছে। এটি তৈরি করেছে যুক্তরাজ্য। ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরুর পর রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা হিসেবে কয়েক শ এনএলএডব্লিউ দেয় যুক্তরাজ্য।
পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে কয়েক শ স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেন
স্টিংগার হলো ভূমি থেকে আকাশে সর্বোচ্চ আট কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম একটি ক্ষেপণাস্ত্র। রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরু করার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে এ ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, রাশিয়া যে ইউক্রেনে এখনো আকাশপথে তেমন শক্তিমত্তা দেখাতে পারেনি, তার একটি বড় কারণ ইউক্রেনের হাতে থাকা শত শত স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র। এর মাধ্যমে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী রাশিয়ার অনেক হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১৫, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,