Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

যুদ্ধ ও শান্তি: ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ (২০২১)

Share on Facebook

লেখক: খুশবন্ত সিং।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, সে সময়ই আপনা থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তিফৌজের। এই বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন মাত্র ১০ হাজার। আজ সেই বাহিনী গণবাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যাতে মুক্তিকামী দেড় লাখের বেশি সশস্ত্র নারী-পুরুষ রয়েছেন এবং আরও লাখ লাখ মানুষ এত যোগ দিতে প্রস্তুত। শান্তিকামী বাঙালির মন কীভাবে ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠল?

১২ নভেম্বর সকালে ব্রিটিশ পতাকাবাহী সাত হাজার টনের কার্গো জাহাজ সিটি অব সেন্ট অ্যালবান্সকে হুগলি নদীর মুখ ধরে কলকাতার দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল। জাহাজটির যত্রতত্র বিভিন্ন আকার-আকৃতির ৭০টি গর্ত ছিল। পরদিন স্থানীয় একটি পত্রিকায় জাহাজটির ছবি প্রকাশ করা হলো। খবরে জানানো হলো, মুক্তিবাহিনীর নতুন নৌশাখা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। রাজ্য সরকার তাৎক্ষণিক এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাতে চাইল। জাহাজের ছবি তুলতে কোনো আলোকচিত্রীকে অনুমতি দেওয়া হলো না। বাকি পত্রিকাগুলো কর্তৃপক্ষের ছোট বয়ানই ছাপল, যাতে বলা হলো, জাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় কোনো এক এলাকায় আক্রান্ত হয়েছিল। আমার মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। জাহাজটা কি পণ্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল? সেই পণ্যগুলোই–বা কী? কোথায় জাহাজটি আক্রান্ত হলো? পাকিস্তানি জলসীমায়, নাকি সাগরের গভীরে? হামলা চালিয়েছে কারা? যদি মুক্তিবাহিনী এই কাজ করে থাকে, যেমনটা ধরে নেওয়া হয়েছে, তাহলে তারা কখন, কীভাবে, কোত্থেকে যুদ্ধজাহাজ পেল? কিছুদিন পর আমি জাহাজটি যেখানে নোঙর করে রাখা, সেখানে যাওয়ার অনুমতি পেলাম। সেখানে যেন পুরোদস্তুর কর্মযজ্ঞ চলছিল। আমি একটি দলের সঙ্গে যোগ দিলাম, যারা ডান দিকটায় গোলার আঘাতে সৃষ্ট গর্ত গুনছিল। আমার একটু আগে থাকা এক ব্যক্তি চিৎকার করল, ‘ছাব্বিশ! আরেক পাশের সমানই হবে। জয় মুক্তিবাহিনী!’ আমি তাঁকে ধরলাম, জানতে চাইলাম, তাঁর কেন মনে হলো যে এ কাজ মুক্তিবাহিনীরই? ‘আর কে হবে?’ তাঁর দাবি। ‘এটা হয় তারা, না হয় আমরা। দুটোই একই কথা। তাদের বিজয় মানে আমাদের বিজয়; তাদের পরাজয় আমাদের পরাজয়।’

কিছু ছোটাছুটির পর কলকাতায় জাহাজটির প্রতিনিধি আমাকে ওই জাহাজে ওঠার অনুমতি দিলেন। সন্ধ্যায় আমি ক্যাপ্টেন হাইনসের কেবিনে হাজির হলাম। তিনি ও তাঁর স্বর্ণকেশী স্ত্রী রোজমেরির সঙ্গে আমি ঘটনাটি নিয়ে আলাপ পাড়লাম। মোটাসোটা স্কটিশ লোকটা তাঁর হঠাৎ আলোচিত হয়ে ওঠার বিষয়টি ভালোই উপভোগ করছিলেন। ‘গত রোববার আমি ব্রিটিশ টেলিভিশনে হাজির হয়েছিলাম, তুমি জানো! আমি তো আর নিজেকে দেখিনি পর্দায়। আর এ বিষয়ে কথা বলার কথাও না আমার। অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কথা বলতে পারব না, যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হয়। দিল্লি থেকে আমাদের নেভাল অ্যাটাশে এসেছিলেন, পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতি দেখে গেছেন। আমি তাঁকে সব বলেছি।’ তারপরই তিনি আমাকেও সব বলে দিলেন। সিটি অব সেন্ট অ্যালবান্স কলকাতায় এসেছিল পণ্য খালাস করতে। ১১ অক্টোবর বিকেলে এটি নোঙর তুলে হুগলি নদী ধরে বঙ্গোপসাগরে যায়। তারপর এটি পাটের চালান নিতে চালনার দিকে চলতে শুরু করে। চালনা পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে কোত্থেকে যেন একটা যুদ্ধজাহাজ, নতুবা কয়েকটা নৌকা হাজির হয়ে জাহাজটিকে ঘিরে ফেলল। ‘১০ মিনিটের জন্য যেন নরক নেমে এল।’ রোজমেরি হাইনস বললেন। ‘গত যুদ্ধের সময় থেকেই আমি এই জাহাজের সঙ্গে আছি’, বলে চললেন ক্যাপ্টেন, ‘তবে কেউ যদি বলে যে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি, তাহলে সে একটা মিথ্যাবাদী। আমরা মুখ ঘুরিয়ে কলকাতার দিকে চলে এলাম।’ আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘সবগুলো গর্তই তো প্রায় একই আকৃতির।’ ক্যাপ্টেন হাইনস জোরের সঙ্গে বললেন, ‘গর্তগুলো একই আকৃতির নয়। আমি বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ নই। তবে আমি বলতে পারি, দুই ধরনের গোলা ছোড়া হয়েছে জাহাজের দিকে। আমরা কিছু শার্পনেল আমাদের নেভাল অ্যাটাশের কাছে হস্তান্তর করেছি।’ ‘কে এই কাজ করে থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’ ‘আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারছি না। এবং কাউকে সন্দেহও করতে পারছি না।’ অখাদ্য এক কাপ চা পান করে আমি হাইনসের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

২.

কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী হলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি পেশিবহুল, কিছুটা দীর্ঘদেহী। কিছুটা কালচে চেহারার ওপর তুষারধবল গোঁফ। কর্নেল ব্লিম্পের কায়দায় অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। তাঁর বচন ছিল ইন্দো-ভারতীয় সামরিক অপভাষায় ঠাসা। এর চেয়ে বেশি মজার কিছু তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর দৃষ্টি ছিল নিষ্প্রভ ও শীতল। তাঁর সঙ্গে যে এক ঘণ্টা আমি কাটালাম, তার মধ্যে একবারের জন্যও তাঁকে হাসতে দেখিনি। তাঁর ‘মহাকাব্যিক’ যুদ্ধ আর তাঁর অধীন ব্যক্তিদের সাহসিকতার কথা বলতে গিয়েই শুধু তাঁর চোখ জ্বলে উঠতে দেখলাম। বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ থেকে যেন ঘৃণা ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল।

কর্নেল ওসমানী পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ ছিল না। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁর একটাই ঠিকানা: ‘বাংলাদেশের কোথাও’। আমাকে তাঁর ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো গভীর রাতে। ঘরে তিনি একাই বসেছিলেন। তাঁর মাথার পেছন দিকটায় জ্বলছিল একটি গ্যাসবাতি। তাঁর সামনের টেবিলটা খালি পড়ে ছিল। তাঁর ঝুপড়ি ঘরের বাঁশের দেয়ালে ছিল না কোনো দিনপঞ্জি কিংবা ছবি। হাত মেলানোর সময় তিনি দৃঢ়ভাবে ঝাঁকুনি দিলেন। কোনো সময়ই অপচয় করলেন না তিনি। জানতে চাইলেন, ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’ আমি তাঁর কাছে সিটি অব সেন্ট অ্যালবান্স সম্পর্কে জানতে চেয়ে শুরু করলাম। জাহাজটির অবস্থান কিংবা নিরস্ত একটি জাহাজে হামলা চালানোর নৈতিকতার প্রশ্ন নিয়ে কর্নেল ওসমানীর কোনো সংশয় ছিল না। ‘জাহাজটা আমাদের জলসীমার মধ্যেই ছিল।’ তিনি স্বীকার করলেন। ‘জাহাজটা আমাদের অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েছিল এবং শত্রুর সঙ্গে বাণিজ্য করছিল। বিশ্ব যদি এক কমবখত কার্গো জাহাজ নিয়ে এতটাই উতলা হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দিতে হয় যে এই পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বরেরা নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালিয়েছে এবং সে সময় কোনো সরকারই তাদের থামার কথা বলতে এগিয়ে আসেনি। সে সময় আন্তর্জাতিক নৈতিকতা কোথায় ছিল, আমি আপনার কাছে জানতে চাই?’ তিনি যেন জ্বলে উঠলেন। আমি সিটি অব সেন্ট অ্যালবান্সের প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার বিষয়টির দিকে আলোচনার মোড় ঘোরালাম।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বয়স তখন ৮ মাস। ১৯৭১ সালের মার্চের সেই রাতে এই যুদ্ধের শুরু, যে রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের বিবেচনায় ‘বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী যেকোনো কিছু’ নির্মূলে অভিযান শুরু করে। ‘কোনো বাহিনী গড়ে তোলার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না।’ বললেন কর্নেল ওসমানী। ‘আমি একজন পেশাদার সৈনিক যে গড়ে উঠেছে এই প্রথাগত নীতি অনুসরণ করে যে সেনাসদস্য অবশ্যই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে পারি, যা আগে কাউকে বলিনি: ১৯ মার্চ নাগাদ যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযান চালাবে বলে ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জনটি তুঙ্গে, সে সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে জ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলতে বলেন। আমি বিশ্বস্ত কর্মকর্তা মেজর খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে গোপন বার্তা পাঠালাম। আমি তিনটা নির্দেশনা দিলাম: রাজনীতিতে জড়িয়ে যেয়ো না; তোমাকে নিরস্ত্র করার সুযোগ দিয়ো না কাউকে; আক্রান্ত হলে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ কোরো। পাকিস্তানিরা যদি শুধু রাজনীতিকদের ওপরই তাদের দমন-পীড়ন সীমিত রাখত, তাহলেও হয়তো সেনাবাহিনী ও পুলিশে থাকা বাঙালিরা নীরব থাকত। যখনই ছড়িয়ে পড়ল যে পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী ও সরকারি কর্মকর্তাদেরসহ নিধন করছে, তখনই আমরা বিদ্রোহ করি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই রাতারাতি মুক্তিবাহিনীর জন্ম দিয়েছে।’

কর্নেল ওসমানী সুনির্দিষ্ট করে কোনো নেতার নাম উল্লেখ করেননি। তবে নয়াদিল্লিতে ১৯৭১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনের দায়িত্ব পালন করা হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী বাংলাদেশে যাওয়ার পর আমাকে বলেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে জ্যেষ্ঠ বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়েছে, নতুবা মাঠপর্যায়ের কাজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মূলত কনিষ্ঠ কর্মকর্তারাই বিদ্রোহ করেছিলেন সে সময়। তিনি তিনজনের নামোল্লেখ করেন—মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গা, মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমানে আহত হয়ে কুমিল্লায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন) এবং মেজর জিয়া, চট্টগ্রাম সেক্টরের কোনো স্থানে। বাঙালি সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্যরা তরুণ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেই প্রতিরোধ গড়ে তুলল এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০ হাজার সদস্যের একটা বাহিনী দাঁড়িয়ে গেল। তাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া কর্নেল ওসমানীকে নিজেদের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বেছে নিলেন। কয়েকটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী মিলে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সদস্যরা। তাঁদের বেশির ভাগই ৪০ বা ৫০ পেরিয়েছেন মাত্র। যদিও তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না, তারপরও তাঁরা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি তাঁদের হাতেই রাখতে চেয়েছিলেন। মূল যোদ্ধারা ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্ত প্রহরার জন্য গঠিত আধা সামরিক বাহিনী), পুলিশ এবং আনসার ও মুজাহিদ, যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল শহর-নগরে শান্তি বজায় রাখতে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞে এই মানুষগুলোর মধ্যে ১০ হাজারের মতো বেঁচে গিয়েছিলেন। এই যোদ্ধারা ছিলেন অরাজনৈতিক। বেশির ভাগেরই পদোন্নতি, পদায়নসহ নানা বিষয়ে বাঙালিদের প্রতি প্রশাসনের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ক্ষোভ ছিল। তারা হয়তো নীরবই থাকত, যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের নিজেদের মতো থাকতে দিত।

তৃতীয় একটি গোষ্ঠীও মুক্তিবাহিনী নামে গড়ে উঠেছিল, যাঁরা ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী (তারা মূলত মাঠপর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেরাই সংগঠিত হয়েছিল)। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তারা ছিল মাধ্যমিক কিংবা বড়জোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই গোষ্ঠীটির মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সে সময় দুটি কমিউনিস্ট পার্টি ছিল। তার মধ্যে পিকিংপন্থী দলটি পরিচিত ছিল তাদের বর্ষীয়ান নেতার নামানুসারে ভাসানী গ্রুপ হিসেবে। আর মস্কোপন্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচিত ছিল মোজাফ্​ফর গ্রুপ হিসেবে। কারখানার যে শ্রমিকেরা এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরাও নিজেদের শ্রমিক সংগঠনের রাজনৈতিক পোশাকটা পরেই এসেছিলেন। গত আগস্টে কো-অর্ডিনেটিং কমিটি অব দ্য লেফট বা সিসিএল গঠন করে বিদ্রোহীদের একজোট করার একটা চেষ্টা হয়েছিল।

ছাত্রনেতা ও তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে আরেকটি গোষ্ঠী সম্প্রতি গড়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠীর নামকরা দুজন নেতা হলেন তোফায়েল আহমেদ ও ফজলুল হক মনি। এই বাহিনী আরও বিস্তৃত পরিসরে অত্যাধুনিক অস্ত্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের সেরা বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশা করেছিল। নিজেদের তারা পরিচয় দিত মুজিব বাহিনী হিসেবে।

মুক্তিবাহিনীর সার্বিক শক্তি কতটা, আমি নিরূপণ করতে পারিনি। কর্নেল ওসমানী এ বিষয়ে আমাকে ধারণা দিতে রাজি হননি। ‘আমি একে গণবাহিনী হিসেবে ডাকতেই বেশি পছন্দ করি। প্রতিটি সক্ষম বাঙালিই মুক্তিবাহিনীর সৈনিক।’ তিনি বলেন। অন্য বেশির ভাগ কর্মকর্তা এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মধ্যেই বলেছিলেন, যা দ্রুতই দেড় লাখে উন্নীত হয়। একটা সময় এর শতভাগ সদস্য মুসলিম ছিলেন। তবে এখন বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার হিন্দুধর্মাবলম্বীও এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। বাঙালি হয়তো ভালো সৈনিক নয়, তবে বোমা, ডিনামাইট ও পিস্তল চালনায় সহজাত দক্ষতাই দেখিয়েছে তারা। ব্রিটিশদের শাসনের সময় ভারতের অন্য সব অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মোটের ওপর যত ইংরেজ হত্যা করেছে, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একাই তার চেয়ে বেশিসংখ্যক ইংরেজ হত্যা করেছে। এবং এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সিংহভাগই আজকের পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মানুষ। কাজেই নগরাঞ্চলের একজন বন্দুকধারী কিংবা বোমা ছুড়ে মারা ব্যক্তিকে পুরোদমে গেরিলাযোদ্ধায় পরিণত করতে খুব বেশি কিছু লাগেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও পাঠানরাই মূলত বাঙালিদের সঙ্গে বৈষম্য করেছে। তাদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। খুব কম বাঙালিই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার জায়গা পর্যন্ত যেতে পেরেছে। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মাত্র একজন বাঙালি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। বিমানবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীতে সমপর্যায়ের পদ পর্যন্ত কোনো বাঙালি কোনো দিন পৌঁছাতেই পারেননি। এ বিষয়টি নিয়েই একবার এক পাঞ্জাবি-পাকিস্তানি বন্ধুর সঙ্গে আমার তর্ক হয়েছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম, পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশই পূর্ব পাকিস্তানের। অথচ সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব ৭ শতাংশের বেশি কোনো দিনও ছিল না। সে বিস্ফোরিত হয়ে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে! ভেড়ার পাল থেকে তুমি কখনো যোদ্ধা পাবে না। এই ডাল-ভাত খাওয়া মানুষগুলো যুদ্ধ করতে পারবে বলে মনে হয় তোমার?’ সিলেটের বাসিন্দা ও শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী আমাকে বলেছেন, বাঙালি তরুণদের হৃদয় কীভাবে ইস্পাতকঠিন হয়ে উঠল। ‘আপনি জানেন, আমরা শান্তিকামী মানুষ। এই পাঠান, বেলুচ (বেলুচিস্তানের মানুষ) ও পাঞ্জাবিদের বর্বরতার কারণেই আমরা যোদ্ধায় পরিণত হয়েছি। তারা তো আমাদের নারী-শিশুদেরও ছাড় দেয়নি। ভিতু প্রাণীও নিজের সঙ্গী-সন্তানদের রক্ষা করতে রুখে দাঁড়ায়। ঘৃণাই মানুষকে ভয়ংকরভাবে লড়াই করতে শেখায়।’ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে নিশ্চিতভাবেই অনেক ঘৃণা জমা পড়েছিল। ‘আপনার আমেরিকান বন্ধুদের বলে দেবেন,’ কর্নেল ওসমানী আমাকে বললেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাত ও ২৬ মার্চ আমাদের জনগণের ওপর যা করেছে, তা কয়েক শ মাই লাই হত্যাযজ্ঞের চেয়েও জঘন্য। তাদের পুরোপুরি নির্মূল না করে আমরা থামব না। তাদের লাশ বাংলাদেশে পচবে, তাদের ভূত আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব।’ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ও তাদের যুদ্ধের সক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছিল। জন্মের দুই মাস পর মুক্তিফৌজ থেকে নাম পরিবর্তন করে এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয় মুক্তিবাহিনী। ‘ফৌজ’ উর্দু শব্দ, আর ‘বাহিনী’ বাংলা শব্দ। নামের পরিভাষাগত এই পরিবর্তন থেকে পুরোপুরি স্থলভিত্তিক গেরিলা বাহিনীর বিস্তারেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যাদের নদীতে সশস্ত্র নৌযান এবং পাকিস্তানি জাহাজে মাইন স্থাপনে সক্ষম জনবলও রয়েছে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এয়ার মার্শাল নিযুক্ত করা হয়। এই বাহিনীর কয়েকজন পাইলট থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো উড়োজাহাজ কিংবা বিমানঘাঁটি নেই। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বলেছিলেন, তাঁরা শিগগিরই যুদ্ধবিমান ও এয়ারস্ট্রিপ পেয়ে যাবেন। ‘আপনারা কোত্থেকে উড়োজাহাজ পাবেন?’ আমি জানতে চাইলাম। জবাবে তিনি কপট হাসি দিলেন। ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর অনেকগুলো প্রশিক্ষণ শিবির ছিল। নিরাপত্তার কারণে এই শিবিরগুলোর সঠিক অবস্থান প্রকাশ করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে জবাবটা আসে, ‘বাংলাদেশের ভেতরেই কোথাও।’ মুক্তিবাহিনী ও তাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি নিয়েও এমন অস্পষ্টতা দেখা গেছে। ‘আপনি আমার কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এটা ভিয়েতনামের গেরিলা সংগঠনের মতো নয়।’ বললেন কর্নেল ওসমানী। ‘প্রাথমিক পর্যায়ে আমি আমার লোকজনকে সেনাবাহিনীর মতোই প্রচলিত প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং প্রচলিত ধারায়ই যুদ্ধ করেছি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বিদেশি শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করবে, যুদ্ধ থামিয়ে পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। কিন্তু যখন তেমনটা হলো না এবং পাকিস্তানিরা সাড়ে চার ডিভিশন সেনা (৮০ হাজার সেনাসদস্য) আনল, সঙ্গে আনল ট্যাংক, ভারী অস্ত্র ও বোমারু বিমান, আমি আমার কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম। গত মে মাসের প্রথম দিকে আমি আমার বাহিনীকে বিকেন্দ্রীকৃত গেরিলা বাহিনীতে পরিণত করলাম এবং কৌশল পরিবর্তন করলাম। আমরা কমান্ডো ধরনের ওত পেতে যুদ্ধের কৌশল নিলাম। আমাদের কিছু জায়গায় পিছু হটতে হয়েছিল ঠিকই, তবে আমরা শত্রুকে ব্যাপকভাবে ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি বৈরী করে তুলতে পারলাম। আমরা তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম। আমরা তাদের হয়রানি করতে থাকলাম। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় আমরা শতাধিক করে শত্রু হত্যা করতে লাগলাম; প্রতিদিন তাদের উড়োজাহাজ বোঝাই করে পশ্চিম পাকিস্তানে কফিন নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই তো গতকালই আমার এক কমান্ডো কুমিল্লার কাছে একটি গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে এসেছে, যেগুলোয় চীনা ও আমেরিকান সিল রয়েছে।’ প্রশিক্ষণ শিবিরে একজন দর্শনার্থী কেবল কাঠের রাইফেল হাতে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বালকদেরই দেখতে পায়। তাদের প্রকৃত অস্ত্রসম্ভার দেখার সুযোগ কাউকে দেওয়া হয় না। আমি যখন জানতে চাইলাম যে এগুলো তারা কোত্থেকে জোগাড় করেছে, জবাবটা বরাবরের মতো একই: ‘মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময় সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্যরা এগুলো নিয়ে এসেছে। বাকিগুলো আমরা শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। আমরা বন্ধুপ্রতিম উৎস থেকেও অস্ত্র কিনি, যার মূল্য পরিশোধ করা হয় বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মাধ্যমে।’ আমি যখন কর্নেল ওসমানীকে জিজ্ঞেস করলাম যে তাঁদের লিম্পেট মাইন ও সশস্ত্র নৌযানগুলো কীভাবে এল, তিনি আমার চোখে চোখ রেখে হাত নেড়ে বললেন, ‘এ বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারব না।’ দায়িত্বের ওপর নির্ভর করে প্রশিক্ষণ পর্ব কয়েক সপ্তাহ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। একটা ট্রেন কীভাবে লাইনচ্যুত করতে হয় কিংবা সড়কে কীভাবে মাইন পুঁততে হয়, তা শিখতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। তবে মর্টারের শেল ছোড়া অথবা স্টেনগান চালনা কিংবা লিম্পেট মাইন স্থাপনে ডুবসাঁতার দেওয়া শিখতে বেশ সময় লাগে। মুক্তিবাহিনীর দাবি করা অর্জনগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিনই বলা চলে। কর্নেল ওসমানী বললেন, ‘সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ আমরা ২৫ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছি, তাদের ২১টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছি, ৬০০ সেতু ও কালভার্ট ধ্বংস করেছি এবং তাদের সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আপনি বিষয়টি যাচাই করে নিতে পারেন। এখন গুটিকয়েক ট্রেন চলছে বাংলাদেশে, চালনায় তো কার্যক্রম বন্ধই হয়ে গেছে। শিগগিরই চট্টগ্রামকেও আমরা স্থবির করে দেব।’ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস অবশ্য বাংলাদেশে নিহত পাকিস্তানির সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার বলে জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকার মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমকে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছিল এই বলে যে তারা ফ্রি বাংলাদেশ রেডিও ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর চিত্রায়িত। সে সময় তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল দুটি: পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর ছেড়ে আসা জাহাজে কর্মরত বাঙালি ক্রু অথবা বিদেশি রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র, যাদের সাংবাদিকদের বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকার বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছে ঘটনাবলি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে। বাঙালি ক্রুরা ডুবিয়ে দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জাহাজগুলোর খবর নিশ্চিত করেছে। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ১৬ হাজার টনের ব্রিটিশ ট্যাংকার টেভিয়ট ব্যাংক চালনা বন্দরে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এর পরপরই আরেক ব্রিটিশ জাহাজ ১০ হাজার টনের চাকদিনাও আক্রান্ত হলো এবং মেরামতের জন্য কলকাতায় ফিরতে বাধ্য হলো। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে (১৪ আগস্ট) চট্টগ্রামে আক্রান্ত হলো ওহরমাজো। অক্টোবর ও নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের তৎপরতা আরও বেড়ে গেল। ৯ অক্টোবর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হাবিব ব্যাংকে, বিশ্বব্যাংকের কার্যালয় ভবনে এবং একটি পাটের গুদামে বিস্ফোরণ ঘটল। বিস্ফোরণে বিশ্বব্যাংক ভবনের একটি তলা ধসে পড়ল। ভারতে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষকেরা মূল্যায়ন করলেন, শান্তিপূর্ণ সময়ে রেলপথে ৩৮ শতাংশ, সড়কপথে ৩৪ শতাংশ এবং নদীপথে ২৮ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। তবে এখন রেল ও সড়কপথে এ হার স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, আর নৌপথে পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান পণ্য পাট এখন পরিবহন করা হচ্ছে কুলির মাধ্যমে। শিল্পোৎপাদন কমে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তামাক উৎপাদন কমে ৪০ শতাংশ হয়েছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় চা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, বাকিরা স্বাভাবিকের তুলনায় ২৫ শতাংশ উৎপাদন করছে। এর সবকিছুরই দায় চাপানো হয়েছে মুক্তিবাহিনীর ওপর। ঢাকায় পাকিস্তান অবজারভার মন্তব্য করেছে, ‘মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনা নির্লজ্জ অপরাধীরা…আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার তৎপরতা দিয়ে তারা অসারতার এক আবহ তৈরি করেছে এবং বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে।’ মুক্তিবাহিনীর সফলতার একটি প্রমাণ হলো তারা ইচ্ছেমাফিক ভারতীয় সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে এবং ফিরিয়ে আনতে পারে। আমি সর্বশেষ সাক্ষাৎ করলাম বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে। আমি যখন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে পৌঁছালাম, সে সময় ঘরটা ছিল লোকে লোকারণ্য। এক কোনায় সোভিয়েত সাংবাদিকদের একটি দলকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে জানানো হচ্ছিল। তাঁরা একটি মানচিত্র ঘেঁটে মুক্তিবাহিনী কোন কোন এলাকা স্বাধীন করেছে, সেগুলো চিহ্নিত করছিলেন।

‘আপনাদের নিয়ন্ত্রণে কতখানি এলাকা? পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কতখানি?’ দোভাষী প্রশ্নটি অনুবাদ করে শোনালেন। ‘পাকিস্তানি বাহিনী যেসব এলাকায় উপস্থিত রয়েছে, সেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাকিগুলো আমাদের। রাতে কেবল সেনাছাউনিগুলোই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যেখানে তারা ঘুমায়। তাদের সঙ্গে সম্মুখসমর এড়িয়ে চলে আমাদের ছেলেরা। তাদের ট্যাংক আছে, যুদ্ধবিমান আছে। আমাদের ছেলেদের কেবল রাইফেল, হাতবোমা, স্টেনগান আর মেশিনগান। যত দ্রুত আমরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র পাব, তত দ্রুতই আমরা তাদের সম্মুখসমরে মোকাবিলা করতে পারব। এর জন্য খুব বেশি সময় লাগবে না।’ ব্রিফিং শেষ হলো। সোভিয়েত দলটির নেতা গণতন্ত্রী বাহিনীর চূড়ান্ত ও অনিবার্য বিজয়ের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণ দিলেন। হাত মেলানো পর্ব আর কুর্নিশ শেষে রাশিয়ানরা চিৎকার করে ‘জয় বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে প্রস্থান করল। কেতাদুরস্ত পোশাকের খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। আমি যখন তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলাম, তিনি নিজের জন্য একটি সিগারেট মোড়াচ্ছিলেন। ‘এখন পবিত্র রমজান মাস’, আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। ‘আপনার রোজা রাখা উচিত।’ তিনি হাসলেন। ‘আমি জানি এবং আজ শবে কদর। কিন্তু জিহাদের (পবিত্র যুদ্ধ) সময় বিশ্বাসীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। মুক্তির জন্য এটা আমাদের জিহাদ।’ বাংলাদেশের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। তিনি আমার হাত ধরলেন এবং বললেন, ‘বন্ধু, আমাদের চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত যেভাবে সহযোগিতা করেছে, তা আমরা ভুলব না। আমরা জানি, আপনারা আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাবারের জোগান দিচ্ছেন। মুক্ত বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আজীবনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে এই ঋণের শোধ দেবে।’ ‘জাতির স্মৃতি দীর্ঘ হয় না বলেই শ্রুত আছে’, আমি জবাবে বললাম। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে ফ্রান্স যেভাবে সহযোগিতা করেছিল, আমেরিকা কি এখন তা ভুলে গেছে? ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার কথা বিন্দুমাত্র ভুলব না আমরা।’

খুশবন্ত সিং: প্রয়াত খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক

অনুবাদ: মো. রাজিউল হাসান

সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৬, ২০২১

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ