ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার তিন মাস পূর্ণ হবে কয়েক দিন বাদেই। এই তিন মাসে রুশ বাহিনী ১০ হাজারের বেশি ‘যুদ্ধাপরাধের’ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দাবি ইউক্রেনের। এরই মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি আদালতে শুরু হয়েছে এসব যুদ্ধাপরাধের বিচার। সেখানে ইউক্রেনের একজন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন এক রুশ সেনা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, ইউক্রেন অভিযানের নির্দেশদাতা হিসেবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও কি যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে? সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেই জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধ কী
যুদ্ধের কিছু আইনকানুন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যুদ্ধের সময় বেসামরিক লোকজনের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো যাবে না। পাশাপাশি তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি অবকাঠামোগুলোর ওপর আঘাত হানা যাবে না।
যুদ্ধে রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের মতো কিছু অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইনে। বলা হয়েছে, রোগাক্রান্ত ও আহত ব্যক্তিদের দেখভালের বিষয়টিও। এর মধ্যে বিরোধী পক্ষের আহত সেনাসদস্যরাও রয়েছেন। যুদ্ধবন্দীদের মতো তাঁরাও একই অধিকার ভোগ করবেন।
এ ছাড়া কোনো গোষ্ঠীর ওপর চালানো নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণকে আইনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ‘গণহত্যা’ হিসেবেও ধরা হবে।
ইউক্রেনে রুশ সেনারা কী করেছেন
কিয়েভের আদালতে রাশিয়ার যে সেনা বেসামরিক নাগরিককে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন, তাঁর নাম ভাদিম শিশিমারিন। বয়স ২১ বছর। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর কয়েক দিন পর ৬২ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি।
গত শুক্রবার হত্যাকাণ্ডের ওই ঘটনায় করা মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর এটাই প্রথম যুদ্ধাপরাধের মামলা শুনানির ঘটনা। ইউক্রেনের সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, নিরস্ত্র ওই লোককে হত্যা করতে ভাদিম শিশিমারিনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
শুনানির বিষয়ে ইউক্রেনের প্রধান কৌঁসুলি ইরিনা ভেনেদিকতোভা এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘এই শুনানির মধ্য দিয়ে আমরা স্পষ্ট সংকেত দিতে চাই যে ইউক্রেনে সংঘটিত অপরাধের নির্দেশদাতা অথবা সহায়তাকারী কেউ নিজের দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারবেন না।’
এর আগে ইরিনা ভেনেদিকতোভা জানান, ইউক্রেনে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা, ধর্ষণ, বেসামরিক অবকাঠামোগুলোতে বোমাবর্ষণ ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে রাশিয়ার ৪১ সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের আরও যেসব অভিযোগ
ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তাদের প্রতিবেদনে বুচাসহ কিয়েভ–সংলগ্ন বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার সেনাদের হাতে বেসামরিক লোকজনের নিহত হওয়ার খবর উঠে এসেছে।
ইউক্রেনে রুশ বাহিনী যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। এ ছাড়া দেশের ভেতর একাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী। সেখানে ইউক্রেনীয়দের হত্যার পর কবর দেওয়া হয়েছিল।
গত মার্চে ইউক্রেনের মারিউপোল শহরের একটি থিয়েটারে বোমা হামলা চালায় রাশিয়া। ওই থিয়েটারে বেসামরিক অনেক লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। হামলায় তাঁদের অনেকেই নিহত হন। এর আগে মারিউপোলের একটি হাসপাতালে বিমান হামলা চালায় রুশ বাহিনী। ওই হামলাকেও যুদ্ধাপরাধ আখ্যা দিয়েছে ইউক্রেন।
সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের যেভাবে বিচার করা যেতে পারে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একাধিক আদালত গঠন করা হয়েছে। আজকের দিনে যুদ্ধে আইনকানুন ঠিকঠাক মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখভালে ভূমিকা পালন করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
এর মধ্যে আইসিজে দুই দেশের মধ্যকার সমস্যা সমাধানে রায় দিতে পারে। তবে আলাদাভাবে কোনো ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে না। অপর দিকে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার করতে পারে আইসিসি।
আইসিজেতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করেছে ইউক্রেন। মামলার রায় যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়, তবে ওই রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।
তবে এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা রয়েছে। তা হলো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের একটি রাশিয়া। ফলে আইসিজের রায় বাস্তবায়নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাব আনা হলে, তাতে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে দেশটির। এমনটি হলে ওই প্রস্তাব স্থগিত হয়ে যাবে।
আইসিসি কি ইউক্রেনে সংঘটিত অপরাধের বিচার করতে পারবে
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে, তা বিশ্বাস করার মতো যুক্তি রয়েছে বলে মনে করেন আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান। তিনি জানান, ইউক্রেনে ইতিমধ্যে একটি তদন্তকারী দল পাঠানো হয়েছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের আগে ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশটির বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ খতিয়ে দেখবে দলটি।
তদন্তকারীরা ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের কোনো প্রমাণ পেলে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সমন জারি করতে ও বিচারের আওতায় আনতে আইসিসির বিচারকদের কাছে আরজি জানাবেন কৌঁসুলিরা।
এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই। তাই অভিযুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে তিনি যে দেশে বসবাস করছেন, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। আর রাশিয়া আইসিসির সদস্যদেশ নয়। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে ক্রেমলিনের সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনাও কম।
পুতিনের কি বিচার হতে পারে
ইউক্রেনে যে রুশ বাহিনী নৃশংসতা চালিয়েছে, এমন দাবির সঙ্গে একমত মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা হিউ উইলিয়ামসন। তাঁর মতে, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য রুশ বাহিনী কার বা কাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছে, তা বের করতে হবে। দেখতে হবে, কোনো নেতা নৃশংসতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না বা নৃশংসতার বিষয়টি জেনেও এড়িয়ে গেছেন কি না। এ ছাড়া ইউক্রেনের ওপর ‘আক্রমণাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার’ অপরাধেও রাশিয়ার নেতাদের বিচার করতে পারে আইসিসি।
তবে রাশিয়ার কোনো নেতাকে আইসিসি এসব অভিযোগে বিচারের আওতায় আনতে পারবে না বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ফিলিপ স্যান্ডস। কারণ সেই আগেরটাই। রাশিয়া আইসিসির সদস্যদেশ নয়।
অপর দিকে নিরাপত্তা পরিষদ ইউক্রেনে রাশিয়ার নৃশংসতার বিষয়টি তদন্ত করতে আইসিসিকে আহ্বান জানাতে পারে। তবে রাশিয়া পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় ভেটো দিয়ে তা স্থগিত করতে পারে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২০, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,