লেখক: কাদির কল্লোল ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির বিধিনিষেধের প্রভাব কত দূর যেতে পারে, তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেন না আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে।
যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং মন্ত্রীরা একই সুরে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতির বিধিনিষেধ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের জন্যই প্রযোজ্য এবং একটা সতর্কবার্তা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিচলিত নয়। কিন্তু দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিষয়টাতে সরকার ও তাঁদের দলের ভেতরে কিছু প্রশ্ন আলোচনায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির প্রভাব কী হতে পারে, সেটি ভাবনায় ফেলেছে আওয়ামী লীগকে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে যারা বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের বিধিনিষেধের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে। কিন্তু তা চিহ্নিত করা হবে কীভাবে, এটি বড় প্রশ্ন আওয়ামী লীগ ও সরকারের কাছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চিহ্নিত করার কথা বলেছে। তাতে আওয়ামী লীগ ও সরকার সন্তুষ্ট হতে পারছে না। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির প্রভাব কী হতে পারে অথবা প্রভাব কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে—এটিও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেন না আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে।
বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতির বিধিনিষেধের বিষয়টি ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে। কে এর আওতায় পড়ে যাবে, সেটা যেমন পরিষ্কার নয় সরকারের কাছে; একই সঙ্গে কাউকে সুনির্দিষ্ট করে নিষেধাজ্ঞা যে দেওয়া হয়নি, সেটাকে একধরনের স্বস্তি হিসেবে দেখছেন ক্ষমতাসীনেরা। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে সব রাজনৈতিক দলের জন্যই বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা তাঁদের আলোচনায় এসেছে। যার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে মন্ত্রীদের বক্তব্যে।
তবে ব্যাখ্যা যা-ই দেওয়া হোক না কেন, বিষয়টা আওয়ামী লীগ ও সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। তা দলের নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের প্রভাব দেশের ভেতরেও পড়তে পারে। বিরোধী দলের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনকে বিভিন্ন সময় ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তাদের আন্দোলন জোরদার করার কথা বলছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কতটা কঠোর হতে পারবে, সেটি ক্ষমতাসীনদের একটি চিন্তার বিষয়। প্রশাসনের ওপর কতটা কর্তৃত্ব রাখা যাবে—এই প্রশ্নেও আলোচনা আছে। প্রশাসনের ভেতরেও এ বিষয় নিয়ে কিছু আলোচনা রয়েছে। অনেকের মধ্যে দুশ্চিন্তাও আছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারও যে একটা চাপের মধ্যে পড়েছে, দলটি সেখানে মন্দের ভালো কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। কারণ, দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ রক্ষা করে সরকারের ওপর একটা চাপ তৈরির চেষ্টা করছিল। তারা বলে আসছিল, আবারও নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষিত ভিসা নীতি কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়; এটি বিধিনিষেধের সতর্কবার্তা।
বিভিন্ন ব্যাখ্যা যে তুলে ধরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে, তাতে বলা হচ্ছে, বিরোধী দল বিএনপিকে এনে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতার কথা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির শর্তে নেই।
এ ছাড়া দেশের সংবিধানের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রক্রিয়া নিয়ে সরকার এগোচ্ছে, তার প্রতিই এই ভিসা নীতি সমর্থন করে। এমন ব্যাখ্যা নিয়েও দলটির ভেতরে আলোচনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতি ঘোষণার পরদিন গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ছয়জন নেতাকে নিয়ে একসঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে যে দুজন ছিলেন তাঁদের মধ্যে দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁদের দল প্রথমত মনে করছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ব্যাপারে শুধু আওয়ামী লীগ ও সরকার দায়বদ্ধ নয়; বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও দায়বদ্ধতা আছে। সেটি আমলে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ওই বৈঠকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে আসছে। এখন বিএনপির এ ধরনের অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, কেউ নির্বাচন প্রতিহত করতে গেলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির আওতায় পড়বে। বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিও এখন দুর্বল হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের পক্ষে এটিকেও ব্যাখ্যা হিসেবে দেখাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, এখন বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচন প্রতিহত করার অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না।
কিন্তু টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ওপরই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার দায়িত্ব বেশি, সেটিও দলটির নেতাদের অনেকে স্বীকার করেন। এরপরও তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় বিচলিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি সবার জন্য সতর্কবার্তা। এই সতর্কবার্তা সব দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।’ একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করছি।’
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, এর পেছনে দেশের কোনো শক্তি বা পক্ষ আছে কি না—এই প্রশ্নও রয়েছে আওয়ামী লীগের। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পেছনে কারও ইন্ধন বা এর সঙ্গে যোগসূত্র আছে কি না, সেটা সরকার খতিয়ে দেখবে।
এ ছাড়া আইনমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এমন পদক্ষেপ নেয় কি না, সেটাও বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ মে নাইজেরিয়ার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এর আগে সোমালিয়া, উগান্ডা, নিকারাগুয়া ও বেলারুশ—এই চারটি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২৭, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,