লেখক: ব্রহ্ম চেলানি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তড়িঘড়ি ও ঝামেলাপূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের ফল হিসেবে আফগানিস্তান আবার সন্ত্রাসীদের কবলে গেল। এর মধ্য দিয়ে আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের বিষণ্ন সমাপ্তি ঘটল। বিশ্বশান্তি ধরে রাখার ‘প্যাক্স আমেরিকানা’খ্যাত যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, তার আনুষ্ঠানিক মরণ-মুহূর্ত হিসেবে তালেবানের এ ক্ষমতারোহণকে ভবিষ্যতে স্মরণ করা হবে। এর মধ্য দিয়েই পশ্চিমাদের সুদীর্ঘকালের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের যবনিকাপাত হলো।
চীনের তৎপরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব যখন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আফগান জনগণকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থার ওপর বড় আঘাত হানল। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের কাছে এ বার্তা গেল, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তার নিজের বিপদের সময়ই মিত্রদের গণনার মধ্যে ধরে। বিপদ কেটে গেলে সে মিত্রদের বিপদের মধ্যে ফেলে পালিয়ে যায়।
সর্বশেষ ঘটনায় আমরা দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র আফগান সরকারকে বাসের চাকার তলায় ফেলেছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক সন্ত্রাসী গ্রুপ তালেবানকে গদিতে বসিয়ে গোটা আফগানিস্তানকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং তালেবান প্রকাশ্যেই সেই চুক্তি লঙ্ঘন করার পরও ট্রাম্পের উত্তরসূরি বাইডেন সেই চুক্তি মেনে নিয়েছেন। আফগান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং তার পরপরই সরকারের পতনের ঘটনার সঙ্গে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার যোগসাজশ রয়েছে। বাইডেন স্বীকার করেছেন, ‘ট্রাম্প আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা আড়াই হাজারে নামিয়ে এনেছিলেন’। এরপর বাইডেন যুদ্ধের মৌসুমে তড়িঘড়ি করে সব সেনা সরিয়ে আনলেন, যা তালেবানকে কাবুল দখলের রাস্তা তৈরি করে দিল।
যুক্তরাষ্ট্র আফগান সেনাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে, যাতে তারা স্বনির্ভর হতে না পারে এবং সব সময় যাতে তাদের মার্কিন বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। বিশেষ করে জঙ্গি বিমানসহ সব সামরিক সরঞ্জাম পরিচালনার ভার মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী নিজেদের হাতে রেখেছিল। সামরিক সরঞ্জাম পরিচালনা ও দেখভাল করা কর্মকর্তা ও কন্ট্রাক্টরদের আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের এভাবে বিপদের মুখে এই প্রথম ফেলে গেছে তা নয়। ২০১৯ সালের শেষ দিকে উত্তর সিরিয়ায় কুর্দিদের একইভাবে তুর্কি বাহিনীর বন্দুকের মুখে তারা ফেলে গিয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যে বাতাসের বীজ বুনেছিল, তার ফসল হিসেবে তাদের ঘূর্ণাবর্ত তুলতে হয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজের সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার অপমান কামাই করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৮ হাজার ২২০ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল, আর আফগানিস্তানে গত ২০ বছরে নিহত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৮ জন মার্কিন সেনা। অর্থাৎ ভিয়েতনামের তুলনায় খুব কম সেনাই খুইয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এ পরাজয় ভূরাজনৈতিক কারণে বৈশ্বিকভাবে অনেক বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত।
পাকিস্তানের মদদপুষ্ট তালেবানের হয়তো বৈশ্বিক কোনো লক্ষ্য নেই। কিন্তু তারা যে সহিংস জিহাদি মতাদর্শ লালন করে, তা আন্তর্জাতিক জিহাদি আন্দোলনকে উজ্জীবিত করবে। এর ফলে অ-সুন্নি ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে সহিংসতার একটা সমূহ হুমকি তৈরি হবে। তালেবানের পুনরায় ক্ষমতা দখল দেখে সহিংস সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো উজ্জীবিত হবে এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসের পুনর্জন্মে এটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। তালেবান সাম্রাজ্যে আল–কায়েদা, আইএস এবং পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর জঙ্গিরা আস্তানা গাড়ার সুযোগ পাবে। আফগানিস্তানে তালেবানের এ একচ্ছত্র আধিপত্য আজ হোক কাল হোক যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের–বাইরের স্বার্থে সন্ত্রাসী হামলার পথ খুলে দেবেই। অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় নেওয়া আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীনকে আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিল। এতে চীনের সম্প্রসারণবাদী আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তাতে বিশ্বসভায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি আরও প্রকাশ্য হয়ে উঠবে।
সুবিধাবাদী চীন এখন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানে আধিপত্য বিস্তার করবে এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করবে। চীন কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা দেওয়ার বিনিময়ে তালেবানকে বলা যায় কিনে নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় উগ্র জিহাদি সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন করে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অবিশ্বস্ততার স্মারক প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হবে। কাবুলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে চিনুক ও ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারে করে ভীতসন্ত্রস্ত আমেরিকানদের সরিয়ে নেওয়ার ছবি ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গনের মার্কিন দূতাবাস থেকে তাদের নাগরিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এসব ছবি আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: আগষ্ট ১৯,২০২১
রেটিং করুনঃ ,