ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ এবং এর জেরে সংঘর্ষের তৃতীয় দিনেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের প্রতিবাদে গতকাল রোববার হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে আরও উত্তাল ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে তিন দিনের সহিংস বিক্ষোভে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ জন এবং হাটহাজারীতে ৪ জন মারা গেছেন। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন কিছু বলেনি। হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্র মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে হেফাজত দাবি করছে, ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে স্থানীয় সংবাদদাতারা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সমর্থক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে অনেক মানুষ আহত হয়েছেন।
গতকাল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, সংঘাত ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সেখানে আগুন, ভাঙচুর ও গুলি—সবই ঘটেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, আওয়ামী লীগের চার নেতার বাড়ি ও সাধারণ সম্পাদকের অফিস, তিনটি গাড়ি ও ১১ মোটরসাইকেলে। ভাঙচুর করা হয়েছে ১০ গাড়ি ও উন্নয়ন মেলার ৩০টির বেশি দোকান। বেসরকারি তিনটি কলেজেও হামলা হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ পুলিশ, ২ সাংবাদিকসহ ৩৪ জন। হামলা হয়েছে ট্রেনেও। এরপর দিনভর ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছাড়াও সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলায়ও হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। সরাইলে গুলিতে দুজন নিহত হয়েছেন।
এর বাইরে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল পর্যন্ত স্থানে সড়ক অবরোধ ও সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন মাদ্রাসার ছাত্ররা। তাঁরা প্রায় ১০০ গাড়ি ভাঙচুর করেন। ১৩টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দিনভর চেষ্টা চালায় বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব। এই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও অনেক স্থানে হরতাল প্রতিরোধে মাঠে ছিলেন। তাঁদের পুলিশের পাশাপাশি অবস্থান করতে দেখা যায়।
হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী গতকাল বিকেলে হাটহাজারীর কাছারি সড়কে সাংবাদিকদের বলেন, হরতালে সারা দেশের জনগণ ও আলেমরা সাড়া দিয়েছেন। সারা দেশের মাদ্রাসায় ‘হামলা ও জুলুম’ হচ্ছে দাবি করে হেফাজতের আমির তা বন্ধের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। তিনি অভিযোগ করেন, গত শুক্রবার বিকেলের মাদ্রাসাছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হাটহাজারীর চারজনকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন অনেক। তাঁর দাবি, এ পর্যন্ত ১৬ জন সারা দেশে নিহত হয়েছেন।
এর ঘণ্টাখানেক পর ঢাকায় হেফাজতের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তিন দিনে ১৭ জন নিহত হয়েছেন।
মোদিবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে এই সংঘাতের সূত্রপাত হয় শুক্রবার জুমার নামাজের পর। সেদিন ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারি দলের হামলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধে। এর জের ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে গুলিতে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এর প্রতিবাদে ওই দিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ, হামলা, ভাঙচুর ও রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেন। সেদিন সেখানে ১ জন নিহত হন। পরদিন আবার বিক্ষোভ-সংঘাতে নিহত হন ছয়জন। গতকাল আরও তিনজন।
মোদির সফরবিরোধী আন্দোলন এখন যেভাবে সংঘাতময় হয়ে উঠেছে, তাতে এর শেষ কোথায়, এ প্রশ্ন সামনে এসেছে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম ছিল আমাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নয়, একজন উগ্র সাম্প্রদায়িক, ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। সেটি ছিল শুধুই ঘৃণা প্রকাশ। কিন্তু সরকার ও প্রশাসন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে রক্তাক্ত করেছে। পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে।’ তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনে আমাদের অর্জন হলো দেশের মানুষ আমাদের দাবির সঙ্গে যে কতটা একমত, তার প্রকাশ হয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এ ধরনের বিষয়ে সরকারের বোধোদয় হবে।’
মোদিবিরোধী আন্দোলন কেবল হেফাজত বা ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়, শুরু থেকে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সমাবেশ করেছিল বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন সংগঠনও। এসব সংগঠনের সঙ্গেও পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল গত বৃহস্পতিবার।
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানানো বা না জানানোর অধিকার মানুষের আছে। কিন্তু সেই অধিকার দমনে সরকারি বিভিন্ন বাহিনী এ সরকারদলীয়দের কর্মকাণ্ড ন্যক্কারজনক। মোদি সরকারের উগ্র সাম্প্রদায়িক আচরণের বিরুদ্ধে ভারতেও আন্দোলন হচ্ছে। মোদির সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধাচরণ করা বাংলাদেশ সরকারেরও দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা সেটা করতে পারেনি।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: মার্চ ২৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,