লেখক: মুনির হাসান
আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তখনকার কম্পিউটার সেন্টারে (বর্তমানে আইআইসিটি) কর্মজীবন শুরু করি; জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেডে, সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে। আমার মাসিক বেতন সাকল্যে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৪০ টাকা। একই সময়ে আমার বন্ধুদের কয়েকজনের চাকরি হয় কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে; সবচেয়ে কম বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা!
এর কয়েক বছর পরে, সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ সালে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফিন্যান্স নতুন একঝাঁক ছেলেমেয়েকে নিয়োগ দেয়। আইডিএলসি সদ্য স্নাতকদের বেতন নির্ধারণ করে ২৫ হাজার টাকা। তত দিনে আমি প্রোগ্রামার হয়ে অষ্টম গ্রেডে উঠেছি। নয় হাজার টাকার মতো পাই। এর মধ্যে বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেতন ২২ থেকে ২৭ হাজার টাকা।
২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ডাক দিলেন। বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে দেশে স্যামসাংয়ের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটকে আনার জন্য দৌড়াদৌড়িতে থাকলাম। উদয় টাওয়ারে তাদের অফিস হওয়ার পর তারা সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ারদের রিক্রুট করতে লাগল; বেতন ৩৫ থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে, গড়ে ৩৮ হাজার। এর কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় বেতন স্কেলের এন্ট্রি পোস্টের মূল বেতন ১১ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের সাকল্যে বেতন দাঁড়াল ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সংবাদপত্রজগতেও একাধিক ওয়েজবোর্ড হয়েছে। সমমানের একজন সংবাদকর্মীর তখন বেতন ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে।
আর এখন? করোনার আগেও একজন ‘সফটওয়্যার শ্রমিক’কে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা সাধা হয়েছে। একটি বড় গার্মেন্টস কারখানার ওয়েলফেয়ার অফিসার সাকল্যে ২০ হাজার টাকা পান। এর মধ্যে শুনলাম একটি বুটিক হাউস তার বিক্রয়কর্মীদের মাসে ১০ হাজার টাকাও দিতে চায় না। অন্যদিকে, নবম জাতীয় বেতন স্কেলে নবম গ্রেডকে দ্বিগুণ করে মূল বেতন করা হয় ২২ হাজার টাকা। গড় বেতন হয় কমপক্ষে ৩৭ হাজার টাকা। একই সময়ে ওয়েজবোর্ড অনুসারে সংবাদপত্রে নিয়োগ পাওয়া সমমানের নতুন কর্মীর বেতন হয়েছে ৩১ হাজার টাকা।
এর ফলে আমাদের সময় বেসরকারি চাকরির প্রতি যে আকর্ষণ ছিল, সেটি কিন্তু নাই হয়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ হলো এন্ট্রি লেভেলে কর্মীদের আর্থিক প্যাকেজ। কিছু করপোরেট ও বহুজাতিক কোম্পানি বাদ দিলে কোনো প্রতিষ্ঠানই এখন আর সরকারি বেতনের কাছাকাছি বেতন দিতে চায় না কিংবা দিতে পারে না। আবার মাসের বেতন পরের মাসের মাঝামাঝি দেওয়া হয় এবং কখনো কখনো কয়েক মাসের বেতনও আটকা পড়ে। অনেক প্রতিষ্ঠানই চাকরি ছেড়ে দেওয়া কর্মীদের প্রাপ্য বেতন কিংবা ছাড়পত্র দিতেও গড়িমসি করে।
পাশাপাশি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নবীন কর্মীদের সঙ্গে শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের আর্থিক প্যাকেজের পার্থক্য অনেক। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী মাসে ১৫ লক্ষাধিক টাকা বেতন পেলেও নতুন কর্মীটি তাঁর বেতনের ৩০ ভাগের ১ ভাগ বেতনও পান না! এর ফল দাঁড়াচ্ছে ভয়াবহ। প্রথমত, আমাদের মেধাবী যুবাদের অধিকাংশই কেবল বিসিএসের পেছনে দৌড়াচ্ছে। যাদের হচ্ছে না, তারাও লেগে থাকছে পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে। তত দিনে তার স্কিলের ধার কমে যাচ্ছে। বিসিএসে ব্যর্থ তরুণ যখন ফিরে আসছে বেসরকারি কর্মবাজারে, তখন তাকে সাধা হয় মানবেতর বেতন। তাতেই তার রাজি হয়ে যেতে হচ্ছে।
মেধাবী কিন্তু বিসিএস হচ্ছে না—এমন লোকজন পাড়ি জমাচ্ছে দেশের বাইরে। গত ১০ বছরে পড়াশোনার জন্য বিদেশগামীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বাড়বেই–বা না কেন? আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারা ইন্টার্নশিপ করলেও ঘণ্টায় ৪০ ডলার বেতন পায়। এমনকি সেটা যদি রিমোট ইন্টার্নশিপও হয়।
যারা একটু ভালো তথ্যপ্রযুক্তির কাজ জানে, তারা গিগ ইকোনমির খোঁজ পেয়ে গেছে। গিগ অর্থনীতি হলো মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি বিশেষ পর্যায়, যেখানে কর্মীরা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত না হয়ে কেবল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। মানে ফ্রিল্যান্স আইটি সার্ভিস। শুধু সফটওয়্যারের লোক নয়, ভালো কনটেন্ট লিখতে পারলে মাসে এক থেকে দেড় হাজার ডলার আয় করা তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই থাকছে না। এন্ট্রি লেভেলে সফটওয়্যার শ্রমিক হিসেবে ঢুকলে তারা সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার বেতন পেত!
সফল ফ্রিল্যান্সারদের দেখে অনেকেই আপ্লুত হচ্ছে এবং সেদিকে যেতে চাইছে। কিন্তু স্কিলের অভাব থাকায় তারা জাপানি গবেষকদের ভাষায় ‘ফ্রিল্যান্স মার্কেটের সবচেয়ে কম দামি’ শ্রমিকের তকমা নিয়ে নিচ্ছে নিজেদের গায়ে। ভালো লোকগুলোকে না পেয়ে ইন্ডাস্ট্রিগুলো হাপিত্যেশ করেই যাচ্ছে। কিংবা একজন আরেকজনের লোক ভাগিয়ে আনছে।
প্রতিবছর আমাদের যে ২২ লক্ষাধিক ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে আসে, তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ সরকারি, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, দেশীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা ওয়েজবোর্ড মেনে চলে—এমন সংবাদপত্রে চাকরি পায়। এর বাইরে একটা বিরাট অংশকে আত্মীকরণ করে আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের ব্যাপারে বিধিবদ্ধ বেতনকাঠামো নেই বললেই চলে। এমনকি ন্যূনতম বেতনের পরিমাণও নির্ধারিত নয়।
এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে মেধাবী তরুণেরা হয় বিদেশে চলে যাবে অথবা দেশে বসে বিদেশি কাজ করবে। আর আমাদের গার্মেন্টস হোক, বায়িং হাউস হোক কিংবা চশমা বিক্রি করার দোকান হোক—কর্মী নিয়ে আসবে দেশের বাইরে থেকে। এখনই নাকি দেশে কয়েক লাখ ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান বা চীনা কর্মী বিরাট অঙ্কের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না বলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো মিড ও টপ লেভেল ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাপকের জন্য চাতক পাখির মতো বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
মাত্র ৩০ বছরে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি খাতের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো খতিয়ে দেখার এখনই সময়। ২০৩০ সাল পর্যন্ত নতুন তিন কোটি কর্ম সৃজনের প্রত্যাশা পূরণের জন্য বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টস–প্রধান
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,