লেখক:জাহাঙ্গীর শাহ।
যুদ্ধের দামামায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে। ফলে তেল, চিনি, গমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের এখন বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রভাব কিন্তু পড়ছে ভোক্তাদের ওপর।
করোনার ধাক্কা সামলে দেশে দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য আগের জায়গা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে। যেমন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ বহু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্য পরিবহনে জাহাজভাড়া করোনার সময়েও বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধের দামামায় তা আর কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। ফলে তেল, চিনি, গমসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য আমদানিতে এখন বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। তাঁদের এখন বেশি দামে বিভিন্ন পণ্য কিনতে হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে চালের দামও বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছেন। জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। বরং অনেকের আয় কমেছে। নতুন কর্মসংস্থানেও ভাটার মধ্যে রয়েছে।
বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। শুল্ক-কর কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা ঠেকানো সম্ভব হয়, এই যা। তবে দাম অস্বাভাবিক বাড়লে পরিস্থিতি সরকারকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
যা–ই হোক, জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে এখন মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। আয় বৃদ্ধির হারও মূল্যস্ফীতির চেয়ে সামান্য বেশি। এর মানে, জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য বা মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষের বাড়তি আয়। আর যাঁদের আয় বাড়েনি তাঁরা ভোগ কমিয়ে জীবনধারণের চেষ্টা করছেন। সার্বিকভাবে, মূল্যস্ফীতিও এখন যুদ্ধের মতো সবার শত্রু হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেট আসছে। নতুন বাজেটে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে—নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
মূল্যস্ফীতির সংকট কাটানোই আগামী বাজেট বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন্য ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের কারণে এমনিতেই অনেকে কাজ হারিয়েছেন, গরিব হয়েছেন। তাঁরা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক এমন সময় যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নতুন সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে দেশের বাজারে তেমন কিছু করার থাকে না। তবে বাজার তদারকি করে অন্যায্য বাড়তি দাম ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে হয়।
গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সেলিম রায়হান। বলেন, সরকার এক কোটি লোককে সুলভে নিত্যপণ্য কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু কারা এই সুবিধা পাবেন, সেই তথ্যভান্ডার সরকারের হাতে নেই। এর আগে কোভিডের সময় ৫০ লাখ গরিব পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া নিয়ে নানা অভিযোগ এসেছে।
দেশের বাজারেও যুদ্ধের অভিঘাত
গত মাসের শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধের দামামায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। চলতি মাসের শুরুতে একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেলের দাম ১৩৯ ডলারে ওঠে। অবশ্য এখন ১০০ ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশে তেলের দামে প্রভাব পড়ে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য এসে পৌঁছানোর আগেই দাম বেড়ে যায়। যেমন, গত দুই মাসে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। করোনার কারণে এমনিতেই জাহাজভাড়া অনেক বেশি বেড়েছে। যুদ্ধের কারণে গত এক–দেড় মাসে জাহাজভাড়াও ১০ শতাংশের মতো বেড়েছে। ফলে দেশের আমদানিকারকদের বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
চাপে মধ্যবিত্তরা
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়ে। তখন তাঁদের বাজারের তালিকা ছোট করতে হয়। যেমন, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যদি সংগতি রেখে আয় না বাড়ে তাহলে খাবারের পাতে মেনু বা পদের সংখ্যা কমে। কিংবা তেল, পেঁয়াজ, চিনির ব্যবহার কমানো ছাড়া বিকল্প থাকে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ দেশে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকে। এর মানে, এক বছরের মাথায় মানুষের বেতন বা মজুরি গড়ে ৬ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পায়। আর মূল্যস্ফীতিও যদি ওই মজুরি বৃদ্ধির হারের কাছাকাছি বা বেশি হয়, তাহলে কষ্ট বাড়ে। বাজার থেকে চাল-ডালসহ পণ্য কেনার সামর্থ্য কমে যায় তাঁদের।
চলতি ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম মাস (গত বছরের জুলাই) মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশের নিচে। ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। জুন মাসের পর থেকে প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। গত ডিসেম্বর মাসে তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারি মাসে তা কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়। চাল-তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে, এটাই স্বাভাবিক বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে গত জুলাই থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মজুরি তেমন বৃদ্ধি পায়নি। মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ১১ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এর মানে, মূল্যস্ফীতি বাড়লেও মানুষের মজুরি তেমন বাড়েনি। ফলে মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে বাড়তি মজুরির টাকা। এখন মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির হার প্রায় সমান হয়ে গেছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ২১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,