লেখা: এএফপি নয়াদিল্লি
বাংলাদেশে ‘স্বৈরশাসক’ শেখ হাসিনা সরকারের পতনে চলতি সপ্তাহে ঢাকায় যখন উৎসব চলছে, তখন সতর্ক অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। বিশ্লেষকদের মতে, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে মোকাবিলা করতে ও ইসলামপন্থী বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে দমনে হাসিনাকে সমর্থন দিত ভারত।
এখন গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় আঞ্চলিক শক্তির কেন্দ্র ভারতের জন্য তৈরি হয়েছে একটি কূটনৈতিক সংকট।
গণ–আন্দোলনের মুখে গত সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়ে দীর্ঘদিনের মিত্র ভারতে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান হাসিনা। তিনি এখনো সে দেশেই অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় অবশ্য এখন দাবি করছেন, তাঁর মা পদত্যাগ করেননি।
শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলেও বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাকে প্রথমেই যাঁরা শুভকামনা জানিয়েছেন, তাঁদের একজন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত বৃহস্পতিবার ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। নয়াদিল্লি বলেছে, ঢাকার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে তারা।
শুধু ভারত নয়, চীনও দ্রুতই ঢাকার নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নকে গুরুত্ব দেবে তারা।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন, যাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন–পীড়ন করেছেন; নয়াদিল্লিও তাদের হুমকি হিসেবে দেখেছে।
ঢাকা এখন হাসিনার বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। অতীতে হাসিনা সরকারকে সমর্থন করা ভবিষ্যতে ভারতের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক থমাস কিন বলেন, ‘বাংলাদেশিদের দৃষ্টিকোণ থেকে গত কয়েক বছর ভারত ভুল পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভারত সরকার নিশ্চিতভাবেই ঢাকায় (ক্ষমতায়) কোনো পরিবর্তন চায়নি। তারা গত কয়েক বছর ধরে স্পষ্ট করে বুঝিয়েছে, প্রতিবেশী দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো সরকার তারা দেখতে চায় না।’
ক্ষতিকর
বাংলাদেশের প্রায় চারপাশেই ভারত। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তির অনেক আগে থেকেই ঐতিহাসিকভাবে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ তারা।
কিন্তু ভারতের ১৪০ কোটি জনসংখ্যা ও প্রভাব বিস্তারকারী অর্থনীতি ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে আচ্ছাদিত করে ফেলে, শেখ হাসিনাও চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রসর হন।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুদেশ ভারত ও চীন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারে ওই দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
শেখ হাসিনা উভয় দেশের (ভারত ও চীন) সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। নয়াদিল্লির কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে সুবিধা নেওয়ার পাশপাশি দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখছিলেন চীনের সঙ্গেও।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন, নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগে দমিয়ে রেখেছেন; নয়াদিল্লিও তাদের অভিন্ন হুমকি হিসেবে দেখেছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘ভারতে ভয় ছিল…হাসিনা ও আওয়ামী লীগের যেকোনো বিকল্পই ভারতের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।’
বাংলাদেশিদের দৃষ্টিকোণ থেকে গত কয়েক বছর ভারত ভুল পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভারত সরকার নিশ্চিতভাবেই ঢাকায় (ক্ষমতায়) কোনো পরিবর্তন চায়নি। তারা গত কয়েক বছর ধরে স্পষ্ট করে বুঝিয়েছে, প্রতিবেশী দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো সরকার তারা দেখতে চায় না।
থমাস কিন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক
‘নয়াদিল্লির চোখে, বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো বিপজ্জনক ইসলামপন্থী শক্তি, যারা ভারতীয় স্বার্থে বিপদ ঢেকে আনতে পারে’, বলেন কুগেলম্যান।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে কেউ কেউ মনে করেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা শেখ হাসিনার সমর্থক।
গত সোমবার থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক শ লোক ভারত সীমান্তে জড়ো হন। তাঁরা ভারতে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বৃহস্পতিবার এক বার্তায় বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার আশা করছেন। হিন্দুসহ বাংলাদেশের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথাও বলেন তিনি।
ফিরবেন তিনি
বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতে হাসিনার আশ্রয় নেওয়া নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
হাসিনা দেশছেড়ে যাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর ভারতীয় পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের নোটিশে’ শেখ হাসিনা ভারতে এসেছেন। আর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবর, হাসিনা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে চান এবং তিনি অন্য কোনো দেশে চলে যাবেন।
কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিক্ষোভ দমনে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় শেখ হাসিনা যে বল প্রয়োগ করেছেন, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের কথা বলেছে লন্ডন। এরপর হাসিনার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এর আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদানের প্রশংসা করেছে। ‘ইসলামি কট্টরপন্থীদের’ দমন করাসহ আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওয়াশিংটন তাঁকে অংশীদার হিসেবে দেখত। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগের জেরে অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
শেখ হাসিনা কত দিন ভারতে থাকবেন বা কোথায় যাবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ঢাকা থেকে নয়াদিল্লির কাছে একটি বিমানঘাঁটিতে আসার পর থেকে তাঁকে একটি গোপন নিরাপদ বাড়িতে রাখা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে তিনি কথা বলেননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেছিলেন, তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারায় তাঁর ‘হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রধান পুতুলের এ পোস্ট এখন অবশ্য মুছে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, শেখ হাসিনা এখনো রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে আশাবাদী ও অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিলে দেশে ফিরবেন বলে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের সংকটের ব্যাখ্যা কী
১১ আগস্ট ২০২৪
শত্রুতা অর্জন
ভারত বর্তমানে যে ‘বিপজ্জনক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের’ মুখোমুখি, তা নিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো সতর্ক করেছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা সতর্ক করে বলেছে, ‘ওই বিপদ কমাতে নয়াদিল্লিকে অবশ্যই সক্রিয় হয়ে কাজ করতে হবে ও সম্পর্কের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি কিছু বিপত্তি দেখা দিতে পারে।’
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে দ্য ইকোনমিস্টে ড. ইউনূস লেখেন, ‘যদিও ভারতের মতো কিছু দেশ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দিয়েছে ও ফলাফল স্বরূপ বাংলাদেশি জনগণের শত্রুতা অর্জন করেছেন, তবে এ ধরনের ফাটল সারানোর অনেক সুযোগ থাকবে।’
ক্রাইসিস গ্রুপের থমাস কিন বলেন, তাঁর বিশ্বাস দুই দেশ বাস্তববাদী সম্পর্কের খাতিরে অতীত সরিয়ে রাখবে। তিনি বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদার এবং বর্তমান পরিস্থিতি পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে না পারার মতো কোনো কারণ নেই।’
অর্থনৈতিক শক্তিই দুই দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করবে বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
আরও পড়ুন
কাদের ও আসাদুজ্জামানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে বাইডেন প্রশাসনকে ছয় কংগ্রেস সদস্যের চিঠি
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ১৩, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,