মা আমার মা,
আমার ছালাম জানবে। আমার ছালাম আমাদের বাড়ির সবাইকে পৌঁছিয়ে দিবে।
বড় আপার মুখে শুনলাম দুলাভাইয়ের বদলি হয়েছে দিনাজপুর শহরে, কিছুদিন পরে আমরা সবাই মিলে প্রিয় কুমিল্লা শহর থেকে সৈয়দপুরে যাব, এ বার বড় আপা আমাকে তোমার কাছে রেখে দিনাজপুরে যাবে ওদের নতুন বাসায়। আমি সৈয়দপুরে গেলে আমি কি মা তোমার সাথে ঘুমাবো !! ঘুমানোর আগে তুমি কি রাজপুত্রের বা ঘুম পাড়ানি মাসি পিসির গান শুনাবে !! নাকি শুধু আমার হাত চেপে ধরে বলবে ‘বাবু কেমন আছো, আমার বাবা’ । কয়েক বছর কাটিয়ে একটু একটু করে বড় হলাম এই প্রিয় শহরে, কুমিল্লা শহর থেকে তোমার কাছে আসার আগে নানান কথা মনে পড়ছে, চিঠিতে কথাগুলি লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে বলে তোমাকেই লিখছি মা। আবার কবে কুমিল্লা শহরে আসব তা তো আর জানি না।
একবার এক ফুফুর মুখে শুনেছি, আমার জন্মের কয়েকদিন আগে থেকে তুমি ভুল কথা বলতে প্রচন্ড যন্ত্রনায় কাতর হয়ে আর আমার জন্মের কয়েক ঘন্টা আগে থেকে তোমার প্রচন্ড যন্ত্রনায় তোমার জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না। আমি জন্মালাম, তুমি আমাকে কাছে রাখতে পারলে না, তোমার সে সামর্থ ছিল না, তুমি খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়লে, অসুস্থ্য থাকতে। তোমার অনেকগুলি সন্তানের পরে আমি হলাম তোমার সর্ব শেষ সন্তান। শুনেছি আমার জন্মের এক বছর পরে বড় আপার বিয়ে হয়েছিল, জন্মের পর থেকে বড় আপার কাছেই থেকে অল্প অল্প করে বড় হচ্ছিলাম। বড় আপা একেবারে আমাদের বাড়ি থেকে বড় দুলাভাই কুমিল্লা শহরে নিয়ে আসবে আমি তখন জানতাম না মা কি !! তেমন করে মা ডাকতেও শুরু করি নি, তখন আমার বয়স শুনেছি প্রায় তিন বছর। কুমিল্লা যাওয়ার আগে আমাকে ঐ বয়সে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমি কার কাছে থাকব !! মায়ের কাছে নাকি বড় আপার কাছে !! আমি বড় আপাকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু কেন বড় আপা !! বা কোথায় আমরা যাচ্ছি, নাঁড়ি ছেড়া মাকে রেখে মায়ের রাজপুত্র কোথায় চলেছে এবার আমি তা কিছুই জানতাম না।
বড় আপা আমাকে সাথে করে কুমিল্লা শহরে নিয়ে আসলো, তখন থেকে আমি কুমিল্লায়, তুমি আমাকে তোমার কাছে রাখতে চেয়েছিলে নাকি আমার ভালো যত্নের জন্যে বড় আপার হাতে তুলে দিয়েছিলে তা আমার জানা নাই। আমার বিশ্বাস, আমার ভালো যত্নের জন্যে তুমি আমাকে বড় আপার হাতে তুলে দিয়েছিলে অথবা আমি হয়তো বড় হতাম দাদু বাড়িতে বা আমাদের বাড়িতে বড় অ-অত্নে। অবহেলায়।
পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতন নরম শিশু- এমনটাই নাকি ছিল ছোট্ট বেলায় আমার বর্ণনা।
আমি বড় আপার সাথে বাড়িতে গেলে তুমি শুধু আমার হাত চেপে ধরে রাখতে কোন কথা বলতে না, শুধু বলতে ‘ বাবু কেমন আছো, আমার বাবা’। কোন দিন জানতে চাইতে না আপার কাছে থাকতে আমার কোন অসুবিধা হয় কিনা না !
হয়তো তোমার আর আমার বুঝায় একটি মিল ছিল, বুঝার শক্তি যখন জন্মাতে শুরু হলো বেশ বুঝেছিলাম বড় আপা আর আমার মা এক নন, অনুভব করতে পারতাম মা অন্য রকমের একজন। যেমন আকাশে চিল উড়ে আকাশের কোন বিরক্তি নেই, প্রচন্ড শীতে খেঁজুড় গাছ যেমন নিজ দেহ কেটে ফোঁটা ফোঁটা রস বিলায় সারা রাত বা সকালের রোদে ছোট্ট নদীতে বা পুকুরে ছোট ছোট মাছরা আনন্দে যেমন করে খেলা মা ঠিক তেমন অথবা পূর্ণীমা রাতে সারা আকাশের মাঝ খানে সেই যে বড় চাঁদ।
আমার বয়স যখন পাচ, তখন বড় আপার ছেলে সাথি জন্মালো, মনে থাকার কথা নয় তবুও মনে আছে আবছা আবছা বড় আপা-দুলাভাই সাথিকে নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমি আলাদা রুমে ঘুমাই, আগে আপাদের সাথে ঘুমাতে কিনা বা আমার স্মৃতিতে তা নেই, আমি রাতে ঘুমের ভান করে থাকতাম অনেক রাতে দুলাভাই এসে আমাকে চেক করে যেত আমার শরীর থেকে চাদর পড়ে গেছে কিনা ! পড়ে গেলে আবার গাঁয়ে দিয়ে দিতেন। মা সত্য করে বলি বড় আপা-দুলাভাই কখনও আমাকে ওদের কোন তফাত ছেলে হিসাবে দেখে নি। একই রঙের জামা, একই রঙের জুতা আমার ও সাথির জন্যে কিনে দিত, তবুও বুঝতে পারতাম সেই সময় মা আর বোন এক নয়, ভিন্ন সঙ্গায়। একটা তফাৎ থাকে তখন থেকে কোন বায়না ধরার বা কোন কিছু চাওয়ার নিয়ম, কৌশল অন্য শিশুদের মত আমার জানা হয় নি।
আমি জানি না মা, সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় সব মাকে কী প্রচন্ড যন্ত্রনায় থাকতে হয় ! সবাই কি জ্ঞান হারায়!! বড় হয়ে যদি ডাক্তার হতে নাও পারি তবুও অনেক অনেক বই পড়ে আমি জানবই সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় সব মাকে কেন প্রচন্ড যন্ত্রনা অনুভব করতে হয়। কঠিন যন্ত্রনায় জন্ম দেওয়া সন্তানের প্রতি প্রতিটি মায়ের কেন এতো অন্ধত্ব !! অন্ধ ভালোবাসা। নাড়ি কাটার পরেরও কোন অদৃশ্য নাড়িতে সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক বাঁধা থেকে যায়। অভিন্ন থেকে যায়। তোমাকে শুধু দেখেছি শুধু কয়েকবার কিন্তু আমার মনে হয়েছে তুমি একজন যাদুকর, একটা যাদুর মায়ার চাদরে আমায় তুমি ঢেকে রাখো, আমার আর কোথাও হয় না যাওয়া, শুধু তোমাকে হয় দেখা, মনে হয় বই হয়ে তুমি আমাকে দেখ, টেবিল হয়ে দেখ আমাকে, আকাশের চাঁদ হয়ে তুমি দেখ বা আকাশের তারা। তেমন করে আমিও তোমাকে দেখি সব সময় মা।
আমার জন্য দোয়া করিও, শরীরের যত্ন নিও, তুমি ভালো থেকো আমার মা।
ইতি
তোমার ছোট্ট ছেলে
কুমিল্লা থেকে।
——————————-
প্রথম আলো আয়োজিত চিঠি উতসব উপলক্ষ্যে লেখা চিঠি।
তারিখ মে ১২, ২০১৩
রেটিং করুনঃ ,