এক চরম স্বার্থপর আত্মসর্বস্ব মানুষের জীবন দর্শন – দস্তয়েভস্কির চোখে
=====================================
আমার ওপর চটবেন না বন্ধু! চটার কারণটা কি? কেবল আমার বাহ্যিক ভঙ্গীর জন্যেই তো, তাই না? কিন্তু সত্যি বলতে কি, আপনিও তো আমার কাছ থেকে এ ছাড়া অন্য কিছু আশা করেননি, তা আমি যেভাবেই না কেন কথা বলি : মিস্টি একটা ভদ্রতা করেই হোক বা এখনকার মতো। সুতরাং তার অর্থটা হতো এখনকার মতোই একই। আমাকে আপনি ঘৃণা করেন, তাই না? দেখেছেন তো আমার মধ্যে কী মধুর এই সরলতা, অকপটতা, কী ভালোমানুষি! আপনার কাছে সবকিছুই স্বীকার করতে রাজি, এমনকি ছেলেমানুষী খেয়ালগুলোর কথাও।
তাহলে বন্ধু আমার, একটি রহস্যের কথা আপনার কাছে আমি উন্মোচন করতে চাই, মনে হয়, সে সম্পর্কে আপনি বিন্দুমাত্র সচেতন নন। একটা কথা বলি শুনুন : যেসব কথা আমরা বলতে ভয় পাই, কোনক্রমেই অন্যের কাছে বলি না, একান্ত বন্ধুর কাছেও বলবার সাহস হয় না, মাঝে মাঝে নিজের কাছেও স্বীকার করতে আপত্তি ঘটে — সেইসব গোপন ভাবনা চিন্তাগুলোকে যদি আমরা সকলেই খুলে বলতে পারতাম, আর তা যদি সম্ভব হত তাহলে পৃথিবীটা এমন দুর্গন্ধে ভরে উঠত যে আমরা সকলেই দম বন্ধ হয়ে মরতাম। সেইজন্যেই বলি, আমাদের সামাজিক শালীনতা, কেতাকায়দাগুলো অত ভালো। গভীর অর্থ আছে ওদের — একথা বলব নাযে সেটা নৈতিক, না, নিতান্তই আত্মরক্ষা, আরাম-সুবিধা — নীতিধর্মের চেয়ে সেটাই ভাল, কেননা নীতিধর্মটাও আসলে ওই আরাম-সুবিধা, একমাত্র ওই আরাম-আয়েসের জন্যেই তা উদ্ভাবিত। পাপাচার, ব্যাভিচার, দুর্নীতির নালিশ আপনি আনছেন আমার বিরুদ্ধে, কিন্তু আমার একমাত্র দোষ সম্ভবত এই যে, আমি অন্যদের চেয়ে বেশি অকপট। তাছাড়া আর কিছু নয়। আগে যা বলেছি, অপরে নিজের কাছ থেকেও যা লুকিয়ে রাখতে চায়, আমি তা লুকিয়ে রাখি না…
(আমার) ব্যক্তিত্ব অর্থহীন নয় — অহম্। সবকিছু আমার জন্যে, দুনিয়ার সৃষ্টি আমার জন্যে। শুনুন, এখনো আমার বিশ্বাস, দুনিয়ায় ভালোভাবেই দিন কাটানো সম্ভব। শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস হল এইটেই, কেননা এ বিশ্বাস ছাড়া খারাপভাবে বাঁচা সম্ভব নয় : বিষপান ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাহলে। লোকে বলে জনৈক নির্বোধ নাকি তাই করেছিল। এমনই দার্শনিকতায় পেয়ে বসল তাকে যে সবকিছু সে নাকচ করতে শুরু করে, এমনকি স্বাভাবিক স্বতঃসিদ্ধ মানবিক কর্তব্যগুলোর বৈধতা পর্যন্ত, পরিশেষে কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। যোগফল দাড়াল শূন্য। সুতরাং সে ঘোষণা করলে যে জীবনের সেরা জিনিস হল সায়ানাইড বিষ। আপনি বলেন, এ হল হ্যামলেট, এ হল ভয়ঙ্কর এক নৈরাশ্য, মোট কথা, মহনীয় এমন একটা কিছু যা আমাদের স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু আপনি বড় মানুশ আর আমি হলাম সাধারণ মানুষ, সুতরাং আমি বলব, সাধারণ ব্যবহারিক দিক থেকে ব্যাপার-স্যাপার দেখা দরকার। আমি যেমন সবকিছু শেকল এমনকি বাধ্যবাধকতা থেকে অনেক দিন হল নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছি। বাধ্যবাধকতা আমার কাছে গ্রাহ্য শুধু তখনই যখন দেখি তা থেকে আমার কিছু লাভ ঘটতে পারে। আপনি অবশ্য সেভাবেই দেখতে পারবেন না, পায়ে আপনার শেকল, রুচি আপনার অসুস্থ। আদর্শের জন্য, সাধুতার জন্যে আপনি ব্যাকুল। কিন্তু আপনি যা বলবেন আমি সব মানতে রাজি, কিন্তু কী আমার করার আছে যখন একথা নিশ্চিত বলে জানি যে, সমস্ত মানবিক সাধুতার মূলে রয়েছে অতি গভীর স্বার্থপরতা। ব্যাপারটা যত সাধু, স্বার্থপরতাও তত বেশি। আত্মপ্রেম — আমি স্বীকার করি এই একটি নিয়ম। জীবন হল একটা ব্যবসায়িক বেচা-কেনা, অথবা টাকা নষ্ট করবেন না, তবে, হ্যাঁ, খরচা করুন উপভোগের জন্যে, তাহলেই আত্মপরিজনের প্রতি আপনার কর্তব্য করা হবে। নৈতিকতা যদি একান্ত চান, তবে এই হল আমার নীতি, যদিও স্বীকার করছি যে আমার মতে আরো ভালো হয় আত্মপরিজনের জন্যে টাকা খরচ না করেই তাকে দিয়ে মুফতে নিজের কাজটা করিয়ে নেওয়া। আদর্শ আমার কিছু নেই এবং তা রাখতেও চাই না। কদাচ তার জন্যে ব্যকুলতা বোধ করিনি। … ভালো জিনিস জীবনে এখনো প্রচুর। আমি ভালোবাসি প্রতিষ্ঠা, পদমর্যাদা, হোটেল, এবং তাসের খেলায় বাজি ধরা। কিন্তু সবার চেয়ে ভালোবাসি মেয়েমানুষ… সবরকমের মেয়েমানুষ; এমনকি গোপন লাম্পট্যও আমার পছন্দ — যত অদ্ভুত আর মৌলিক ধরনের হবে ততই ভালো, বৈচিত্রের জন্যে একটু নোংরামিও চাই আর কি… হা হা হা।
হে বন্ধু আপনি যদি সাচ্চা মানবপ্রেমিক হোন তাহলে আপনার কামনা করা উচিত যেন সমস্ত বুদ্ধিমান লোকেদেরই রুচিটা হয় আমার মতো, এমনকি ওই নোংরামিটুকু থাকলেও, নইলে দুনিয়ায় বুদ্ধিমান লোকের করার কিছু থাকবে না, থাকবে শুধু নির্বোধরা। আর জানেন তো, বোকাদের মধ্যে বাস করা আর কথায় কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করা যাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই : লাভ আছে তাতে। আমি তো দেখছিই এক ফাঁপা সমাজে বাস করছি, কিন্তু যতদিন আরামে আছি, তার মতামতে হ্যাঁ হ্যাঁ করে যাব, সুবিধা পেলেই সর্বাগ্রে সে সমাজ পরিত্যাগ করব। আপনাদের আধুনিক আইডিয়াগুলো আমার জানা, যদিও তাতে কখনো পীড়িত হইনি, পীড়িত হওয়ার মতো তাতে কী আছে? কখনো কিছুতেই বিবেক দংশন আমার জাগেনি। আরামে থাকতে পেলে সবকিছু মানতে আমি রাজী, এবং আমার মতো লোক অসংখ্য, আর সত্যিই আছিও আমরা আরামে। দুনিয়ায় সবকিছু ধ্বংস পেতে পারে কেবল আমাদের কখনো ধ্বংস নেই। দুনিয়ার অস্তিত্বের দিন থেকে আমরা আছি। সারা বিশ্ব কোন দিন ডুবতে পারে, কিন্তু আমরা, আমরা ভেসে উঠব ওপরে। প্রসঙ্গত, আমাদের মতো লোকেদের প্রাণোশক্তির কথাটা একটু ভেবে দেখুন। আমরা যে অসাধারণ রকমের দুর্মর; তাতে কখনও অবাক লাগেনি আপনার? তার মানে প্রকৃতি স্বয়ং আমাদের রক্ষা করে। মৃত্যু আমি ভালোবাসি না, ভয় করে। শুধু শয়তানই জানে কীভাবে মরতে হবে। কিন্তু কি হবে এসব কথা বলে? চুলোয় যাক গে দর্শন। পান করা যাক হে বন্ধু, আসুন…
ফিয়োদর দস্তইয়েভস্কি (বঞ্চিত লাঞ্ছিত)
[The Insulted and Humiliated]
অনুবাদঃ ননী ভৌমিক
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,