অংকের সূত্রগুলি, রসায়েনের সূত্র গুলি, জ্যামিতি বা পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলি সেই সাথে জেনে রাখা ইংরেজী শব্দ ও গ্রামারের ধারাগুলি অবিকল যদি মনে থাকত তবে একজন ভালো ছাত্র হয়ে উন্নতির অনেক ধাপ পেরয়ে অনেক উপরে উঠে যেতাম নিশ্চিত, মাথার ভিতরে যেখানে নানান কথা, অনুভূতি, জীবনের দেখা নানা দৃশ্য সেখানে ধূলা ময়লার মত কিছু জমে জমে ভুলেছি অনেক কিছু, আবার অনেক কিছু অষ্পষ্ট বা আজ আবছা আবছা।
যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় তা হচ্ছে স্মৃতি। স্মৃতি কথাটির সাথে স্মৃতি শক্তি কথাটি বেশ যুক্ত, অর্থাৎ অনেক মানুষের স্মৃতি শক্তি খুব প্রখর আবার অনেকের স্মৃতি শক্তি খুব দূর্বল।
মস্তিষ্কে বা মাথায় নানান তথ্য ধারণ করে রাখার প্রক্রিয়াকে বা ধারণকৃত তথ্যকে স্মৃতি বলে – এ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কে প্রথমে তথ্য আহরণ করে মস্তিষ্কে জমা করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেই তথ্য আবার স্মৃতি ভান্ডার থেকে খুঁজে নিয়ে আসা হয়।
যে সূত্রগুলি মনে দীর্ঘদিন ধারণ করতে চেয়েছি, তা হয়তো ভুলে গিয়েছি, স্মৃতির ভান্ডার ভরে আছে অন্য কিছুতে। স্মৃতির উপর আমার যে কোন নিয়ন্ত্রন নেই তা বেশ জোড় দিয়ে বলতে পারি, স্মৃতি ঘরে যা ষ্পষ্ট হয়ে থাকার কথা ছিল তা গিয়েছে মুছে অথবা আবছার আবরণে মোড়ানো। আবার স্মৃতি ঘরে ষ্পষ্ট করে যা মনে রাখার প্রয়োজন ছিল না আর এ কারণেই জীবনের গতি ভিন্ন ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে সঠিক লক্ষ্য থেকে।
অংকের সূত্রগুলি যদি স্মৃতিতে ভালো কাজ করত তবে আজ হয়তো একজন ছড়াকার বা গল্পকার না হয়ে গণিতে বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে অনেক ভালো করতে পারতাম।
ছোট্ট বেলার জুঁই স্মৃতি ঘর থেকে মুছে না গেলে হয় তো চাঁমেলিকে নিয়ে কবিতা গল্প লেখা হতো না। জ্যোতির কথা, জ্যোতির শেষ ঋণের কথা স্মৃতি ঘরে থেকে গেলে হয় তো আলোর সাথে ঘর বাঁধা হতো না, হাতে হাত রেখে আলোকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেতো না।
স্মৃতিকে আর ভুলে যাওয়াকে বার বার আমার কাছে বড় একটি বিশ্ময় মনে হয়েছে। কাউকে স্মৃতি ঘরে রেখে কি সুখি হওয়া যায় ! নাকি দুঃখে থাকা, দুঃখের সাথে বসবাস ! নাকি স্মৃতি ঘরের কাউকে ভুলে যেতে পারলেই কী সুখ এসে ধরা দেয় !
দুঃখগুলির আকার বড় বড়, গভিরতাও অনেক আর স্মৃতি ঘরে বড় বড় জায়গা দখল করে রাখে শেষ পর্যন্ত আর যাকে ভোল যায় না তিনি বা তার স্মৃতি কিম্বা মনে ধারণ করা কোন সূত্র বা বিশ্বাসগুলি আমাদের বড় সম্পদ বা অর্জন, তা কখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণে থেকে বা কখনও নিয়ন্ত্রনের বাইরে থেকে মনের অজান্তেই তৈরী হয়েছে।
আমার স্মৃতি ঘরে থাকা কেউ যে আমাকে বিচলিত করে, চিন্তিত করে, আমাকে পরিচালিত করে, সুখের দু:খের দোলায় দোল খাওয়ায়, কল্পনার আকাশে উড়ে নিয়ে যায় তা আমার কাছে বেশ ষ্পষ্ট। অনেক কিছু কেন ভুলেছি, অনেককে কেন ভুলে যায় নি, কেন মনে রেখিছি – এ রহস্যে আমি ঘোর পাক খাই নিত্য।
বিবিধ লেখাটি লিখতে গিয়ে – জীবনানন্দ দাশের ” স্মৃতি” কবিতার কথা মনে পড়ে গেল –
” থমথমে রাত, আমার পাশে বসল অতিথি-
বললে, আমি অতীত ক্ষুধা-তোমার অতীত স্মৃতি!
-যে দিনগুলো সাঙ্গ হল ঝড়বাদলের জলে,
শুষে গেল মেরুর হিমে, মরুর অনলে,
ছায়ার মতো মিশেছিলাম আমি তাদের সনে;
তারা কোথায়?-বন্দি স্মৃতিই কাঁদছে তোমার মনে!
কাঁদছে তোমার মনের খাকে, চাপা ছাইয়ের তলে,
কাঁদছে তোমার স্যাঁত্সেঁতে শ্বাস-ভিজা চোখের জলে,
………………………
ঝিম্ঝিমে চোখ, জটা তোমার ভাসছে হাওয়ার ঝড়ে,
শ্মশানশিঙা বাজল তোমার প্রেতের গলার স্বরে!
আমার চোখের তারার সনে তোমার আঁখির তারা
মিলে গেল, তোমার মাঝে আবার হলেম হারা!
-হারিয়ে গেলাম ত্রিশূলমূলে, শিবের দেউলদ্বারে;
কাঁদছে স্মৃতি-কে দেবে গো-মুক্তি দেবে তারে! ” – – জীবনানন্দ দাশ।
তারিখ: আগষ্ট ২২, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,