লেখক: দারিয়ুস গাফিচুক
ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পেছনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুক্তি ছিল, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রচেষ্টার কারণে ভূরাজনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছিল রাশিয়া। এ যুদ্ধ ছয় মাসে পড়ার পর এখন আরও স্পষ্ট হয়েছে পুতিনের যুক্তি কতটা ভ্রান্ত।
এ কারণেই পুতিন ও তাঁর উপদেষ্টাদের ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে এমন কী কী বিষয় থাকতে পারে, সেটা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে ঐতিহাসিক সেরহি পলকির লেখা ‘লস্ট কিংডম, আ হিস্টি অব রাশিয়ান ন্যাশনালিজম ফ্রম আইভ্যান দ্য গ্রেট টু ভ্লাদিমির পুতিন’ শীর্ষক গবেষণায় এর একটি কারণ পাওয়া যায়। তাঁর মতে, ‘আজকের রাশিয়ায়, রুশরা তাদের জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও পরিচয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়ান ফেডারেশনের যে রাজনৈতিক ভূখণ্ড এবং রাশিয়া সম্পর্কে তাঁদের মনোজগতে বিরাজ করা মানচিত্র—দুয়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপন করতে গিয়ে বিশাল ঝামেলার মধ্যে পড়ে যায়।’
বেশির ভাগ দেশে জনমানুষের সামষ্টিক চেতনা কিছুটা হলেও মিথের ওপর নির্ভর করে। জনগণের একটি বড় অংশ মিথকে জাতীয় ইতিহাস বলে মনে করেন। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জনচৈতন্য—সবখানেই হারানো অতীতকে খোঁজা হয়। কমিউনিস্ট আমলের ঐক্যবদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো রাশিয়ানদের স্মৃতি তাড়িয়ে ফেরে।
সোভিয়েত হারানোর মর্মবেদনা রাশিয়ার ওপর সরাসরি একটি চ্যালেঞ্জ চাপিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই তারা অস্তিত্বগতভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সোভিয়েত-পরবর্তী জমানায় রুশরা নিজেদের ভুক্তভোগী বলে মনে করে, তার পেছনের গল্পটা এটাই। এ কারণেই রাশিয়া নিয়ে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি নবম শতকের রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। রুশ জাতীয়তাবাদের কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তাঁর অনুসারীরা ‘কিয়েভান রুশ’ সাম্রাজ্যের উদাহরণ দেন।
যদিও এই ইতিহাস বাদ দিলে রাশিয়া তুলনামূলকভাবে খুব বেশি পুরোনো দেশ নয়। ব্যতিক্রম শুধু তৃতীয় আইভ্যান। ১৪৬০-এর দশকে তিনি তাসার রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন (যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাম্রাজ্য খুব একটা স্বীকৃত নয়)। ২০০ বছর শাসিত হওয়ার পর তৃতীয় আইভ্যানই মঙ্গল সাম্রাজ্যকে সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন। অতীতে কিয়েভ রাশিয়ার মতো সামন্তীয় মঙ্গল সাম্রাজ্যের রাজ্য ছিল। কিন্তু কিয়েভ এখন ইউক্রেনের রাজধানী। এর নিজস্ব ইতিহাস ও জাতীয় চেতনা রয়েছে।
এসব সামঞ্জস্যহীন ইতিহাস থেকেই বর্তমানে অন্যের ওপর নিপীড়নের রসদ পায় ক্রেমলিন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস থেকেও ইউক্রেন আগ্রাসনের ন্যায্যতা খুঁজে নেয় তারা। ক্রেমলিনের কর্তারা বলছেন, রাশিয়া এখন ইউক্রেনে নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। ১৯৯০-এর দশকটি ছিল সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সময়, তখন কিছুটা আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। রাশিয়া তখন মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে পশ্চিমা উদারনৈতিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দুই দশক ধরে বাণিজ্যের মাধ্যমে সমাজবদলের এই ধারণার অগ্রদূত। কিন্তু সেই বদলটা আসেনি। গত মে মাসে রাশিয়ার বিজয় দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানের একটি ঘটনাতেও পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিশ্বদৃষ্টির পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে জেড প্রতীকসংবলিত (যুদ্ধপন্থী) ট্যাঙ্কে চেপে কুচকাওয়াজে অংশ নিতে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের পোশাক পরা সেনারা ট্যাঙ্কটি ঘিরে ছিলেন।
রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কেভিন প্ল্যাট ২০২০ সালে একটি বই লেখেন। পাওয়ার অ্যান্ড টাইম নামে বইটিতে তিনি লেখেন, ‘বর্তমানের কোনো বিষয়কে অতীতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার একটা অদ্ভুত সামর্থ্য রয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের প্রথম মেয়াদে রুশ পরিচালক আলেক্সান্ডার সোকুরোভ রাশিয়ান আর্ক নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্র ইতিহাস সম্পর্কে রাশিয়া যে বয়ান নির্মাণ করতে চায়, তারই একটি সংস্করণ। ৯০ মিনিটের চলচ্চিত্রটি কোনো কর্তন বা সম্পাদনা ছাড়াই একটি মাত্র শটে ধারণ করা। বিখ্যাত হারমিটেজ আর্ট গ্যালারিতে একদিনে পুরো চলচ্চিত্রটি ধারণ করা হয়েছিল। পরিচালক সুকোরভ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাদের অতীত এখনো অতীত হয়নি। আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমরা জানি না কখন সেগুলো অতীত হয়ে যাবে।’
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের জন্য নতুন এক অতীত তৈরি করতে চেষ্টা করছে রাশিয়া। খনিজবিদ্যায় সিউডোমরফোসিস বা ছদ্ম রূপান্তর বলে একটি বিষয় আছে, তার সঙ্গে রাশিয়ার এই প্রচেষ্টার মিল রয়েছে। জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংগ্লার ১৯২০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বের অবক্ষয়কে ব্যাখ্যা করতে এ ধারণা ব্যবহার করেছিলেন। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও এখন সেটা সত্য। সিউডোমরফোসিস বা ছদ্ম রূপান্তর হলো সেটা যখন, ভেতরের উপকরণের সঙ্গে বাইরের চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত।
একটু কষ্ট করে মাথা খাটালেই ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির একটি ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। অন্য একটি দেশের বর্তমানকে নিজের দেশের অতীত পড়তে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া।
***এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
***দারিয়ুস গাফিচুক নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের প্রভাষক।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ৩০, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,