বাংলা বানানের বিবর্তন: ‘কি’ বনাম ‘কী’, ও রবীন্দ্রনাথ সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
আমরা অনেকেই, ‘কি’ ও ‘কী’-এর ব্যবহার করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ি। আর একথা স্বচ্ছন্দে বলা যায়, এই ঝামেলার জনক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই।
আসুন দেখাই যাক এ ব্যাপারে আধুনিক প্রমিত বানানরীতি কী বলে!
বলা হয়েছে :
“সর্বনাম পদরূপে এবং বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ পদরূপে ‘কী’ শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে।” যেমন: কী খাচ্ছ এসব ছাইপাঁশ? কী বলছ? বাংলা? কী আস্পর্ধা!
“অন্য ক্ষেত্রে অব্যয় পদরূপে ই-কার দিয়ে ‘কি’ শব্দটি লেখা হবে।” যেমন : “তুমিও কি খাবে?” “মাস্টারের চোখের সামনে কি কোন ছাত্র এসব খায়?” আবার: “কি বাংলা কি বিলিতি, আমার কোনটাতেই আপত্তি নেই স্যার।”
এখানে জাস্ট বলে রাখি, কীভাবে, কিনা, নাকি, কীরে, কীসে এক সঙ্গে লেখা হবে।
এবার বলবেন, “অ! এর মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ! সব ব্যাপারে বাঙালির ওনাকে টেনে না আনলে কি আর হয়?” আজ্ঞে স্যার, এ সত্যিই এক বদভ্যেস। তবু, কিছু তথ্য দিচ্ছি।
শ্রীমণীন্দ্রকুমার ঘোষ মহাশয় তাঁর ‘বাংলা বানান’ বইতে লিখছেন, “তবে একথা ঠিক যে প্রাচীন পদকর্তারা নির্বিচারে ‘কি’ ও ‘কী’ ব্যবহার করিয়াছেন। কোন প্রকার অর্থ-বৈলক্ষণ্য দেখান নাই। বর্তমান যুগে রবীন্দ্রনাথই অর্থ-পার্থক্য দেখাইয়া ‘কী’ বানান প্রচলন করিয়াছেন।” (বাংলা বানান, পৃ. ৭৯)
রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম তাঁর ভিন্নমত প্রকাশ করেন (বকলমে), ১৩৩২ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘চ’ল্তি ভাষার বানান’ নামে একটি নিবন্ধতে। লেখকের নাম প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
ইন্টারেস্টিং?
মহলানবিশ মহাশয় লিখেছিলেন, ‘কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থস্বত্ত্ব যখন বিশ্বভারতীর হাতে আসে, তখন বাঙ্লা বানান, বিশেষত ‘চ’ল্তি ভাষার বানান-সম্বন্ধে একটি সাধারণ রীতি অবলম্বন করবার কথা হয়। এ কাজের প্রধান কর্ত্তা শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এমএ. ডিলিট্, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা ভাষাতত্ত্ব-অধ্যাপক। শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিএ. (প্রবাসীর ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙ্লার অধ্যাপক, এ কাজে সাহায্য ক’রেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে সাধারণভাবে এই পদ্ধতিটিকে অনুমোদন ক’রে দিয়েছেন।’ (‘চ’ল্তি ভাষার বানান,’ পৃ. ৩০১)।
ভাষা, হাইফেন এবং ঊর্ধ্ব-কমার ব্যবহারটা লক্ষ করুন।
শ্রীপ্রশান্তচন্দ্রের প্রবন্ধে এও জানানো হলো, ‘এখন থেকে বিশ্বভারতী কর্ত্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা এই পদ্ধতি অনুসারে ছাপা হবে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ও এই রীতিটিকে অনুমোদন ক’রেছেন।’ (‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, পৃ. ৩১০)
বিশ্বভারতীর ৬ নিয়মের ২ উপনিয়ম এই: “সাধুভাষা ও ‘চ’ল্তি ভাষা দুয়েতেই প্রশ্নসূচক অব্যয় কি [হ্রস্ব] ই-কার দিয়ে লেখা হবে। নির্দ্দেশক সর্ব্বনাম ‘কী’ [দীর্ঘ] ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন: তুমি কি খাবে? [অব্যয়], তুমি কী খাবে? [সর্ব্বনাম], তুমি কী কী খাবে [সর্ব্বনাম]।” [‘চ’ল্তি ভাষার বানান’, পৃ. ৩০৯]
কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথের পূর্বে প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কারো রচনায় একটাও ‘কী’ বানান পাই কি?
পণ্ডিত হরনাথ ঘোষ ও সুকুমার সেনের ‘বাঙ্লা ভাষার ব্যাকরণ’ বইতে শুধু এক জায়গায় ‘কী’ শব্দের ব্যবহার দেখানো হয়েছে নিছক বিকল্প হিসেবে। লেখা আছে, ‘তুমি কি (বা কী) বই পড়িতেছ বল।’ (পৃ. ২৭৭)
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি শুধু এক কারণে ‘কী’ লেখা যায় বলেছেন। তা হল ‘ক্রোধে’ ও ‘ক্ষোভে’-যেমন: ‘কী, —কী এত আস্পর্ধা!’ (বাঙ্গালা ভাষা, প্রথম ভাগ [ব্যাকরণ], পৃ. ২৩৮)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োজিত বানান সংস্কার সমিতি ও পরিভাষা সমিতির সভাপতি রাজশেখর বসুর সম্পাদিত ‘চলন্তিকা’য় ‘কী’ শব্দ যেখানে আছে সেখানে তিনি বলেছেন, কী – ‘কি দেখ’। অর্থাৎ, মানে এক।
চলন্তিকায় শেষে অবশ্য ‘কী’শব্দ স্বীকার করা হয়েছে: “বেশী জোর দিতে, যথা— ‘কী সুন্দর!’ ‘তোমার কী হয়েছে?’
কিন্তু কেবলমাত্র এই ‘কি’ আর ‘কী’ নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিমত মান-অভিমান পালা চলে, সেও প্রায় বছর তিনেক।
১৯৩৬ সালের মে মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ পত্রে উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রথম বাংলা ভাষা সংশোধন পর্বের সূচনা করলেন।
বানান সংস্কার সমিতির সদস্য শ্রীবিজনবিহারী ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘কিছুকাল পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চলিত বাংলা ভাষার বানানের রীতি নির্দিষ্ট করিয়া দিবার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। গত নভেম্বর (১৯৩৫) মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম সংকলনের জন্য একটি সমিতি গঠিত করেন। উদ্যোক্তা উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ প্রধান সমর্থক। দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি প্রধান অংশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন।’ (বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, পৃ. ২৩)
‘কি’ ও ‘কী’ বানানের নিয়ম কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করেনি। তিনটে সংস্করণ মিলিয়ে দেখলে বেশ মজা পাবেন।
প্রথম সংস্করণে এই নিয়ম নেই। দ্বিতীয় সংস্করণে আছে। তৃতীয় সংস্করণে আবার বাদ!
দ্বিতীয় সংস্করণে (সেপ্টেম্বর ১৯৩৬) লেখা ছিল, “অব্যয় হইলে ‘কি’, সর্বনাম হইলে বিকল্পে ‘কী’ বা ‘কি’ হইবে, যথা: ‘তুমি কি যাইবে? তুমি কী (কি) খাইবে বল’।” (নিয়ম ৭)
এর সপক্ষে একটা যুক্তিও পেশ করা হয়েছিল, ‘অর্থ প্রকাশের সুবিধার নিমিত্ত ‘কি’ ও ‘কী’র ভেদ বিকল্পে বিহিত হইল।’
এই দ্বিতীয় সংস্করণের গোড়াতেই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য স্বরূপ এই কথাগুলো ছাপা হলো — ‘বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬।’
নীচে আরও ছাপা হলো..
‘শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১লা আশ্বিন, ১৩৪৩।’ (মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, পৃ. ১৬)
বুঝুন ব্যাপারটা! কিন্তু, এই ঘটনা এখানেই শেষ হলো না। বের হলো তৃতীয় সংস্করণ ১৯৩৭ সালের জুন মাসে। এই সংস্করণে আবার এই নিয়ম বাদ পড়ল। রবীন্দ্রনাথ সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেন। কবির ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ দেখুন। ‘এই বই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করলেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানবিধি প্রথম সুযোগেই পরিত্যাগ করলেন।’ (মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, ‘বানান সংস্কারের চিন্তা অবান্তর নয়,’ পৃ. ৩৬০)
যে মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা বানানের নিয়ম’, শেষ সংস্করণ, জুলাই ১৯৩৭ সালে প্রকাশ করল, অভিমানি রবীন্দ্রনাথ আলমোড়া থেকে চিঠিতে লিখছেন, ‘তৎসম শব্দ সম্বন্ধে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপণ্ডিতের অধিকারই প্রবল, অতএব এখানে আমার মতো মানুষের কথাও চলবে… কিছু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মতে মিলছি নে সেখানে আমি নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেন না, অক্ষরকৃত অসত্যভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম তা আমি বলব না— এমন-কি, হয়তো— থাক আর কাজ নেই।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৭)
এ ব্যাপারে মণীন্দ্রকুমার ঘোষ বলছেন, “মৌখিক ভাষায় আমরা শুধু ‘কি’ শব্দের উপরই জোর দিই না, অন্যান্য শব্দের উপরও জোর দিয়া থাকি। কিন্তু সেজন্য লৈখিক ভাষায় এ সমস্ত শব্দের বানান-পরিবর্তন আবশ্যক হয় না, কেবল ‘কি’ শব্দের বেলাই বানান-পরিবর্তন হইবে কেন? ‘তুমি খেয়েছ কিনা’, এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে আমরা বলি ‘তুমি কি খেয়েছ?’—জোর দেওয়া হয় ‘খেয়েছ’ শব্দের উপর। কিন্তু যদি উত্তর না দেও, কিংবা উত্তর দিতে বিলম্ব কর, তখন বিরক্ত হইয়া একই প্রশ্ন একটু পাল্টাইয়া বলি ‘তুমি খেয়েছ কি?’—এবার জোর পড়িতেছে ‘কি’ শব্দের উপর। এইজন্য যদি ‘কি’ শব্দের বানান বদলাইতে হয়, তাহা হইলে ‘তুমি’শব্দের উপর জোর দিলে ‘তুমি’ শব্দেরও বানান বদলাইতে হয়।” (বাংলা বানান, পৃ. ৮০)
অর্থাৎ স্ত্রী স্বামীকে বলছেন, “শেষবারের মত বলছি, খেতে আসবে তুমী?”
কিন্তু তিনিও পরে রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়ে লিখছেন: “প্রশ্নসূচক অব্যয় ‘কি’এবং প্রশ্নসূচক সর্বনাম ‘কি’উভয়ের কি এক বানান থাকা উচিত? আমার মতে বানানের ভেদ থাকা আবশ্যক। একটাতে হ্রস্ব-ই ও অন্যটাতে দীর্ঘ-ঈ দিলে উভয়ের ভিন্ন জাতি এবং ভিন্ন অর্থ বোঝার সুবিধা হয়। ‘তুমি কি রাঁধছ’, ‘তুমি কী রাঁধছ’— বলা বাহুল্য এ দুটো বাক্যের ব্যঞ্জনা স্বতন্ত্র। তুমি রাঁধছ কিনা, এবং তুমি কোন্ জিনিস রাঁধছ, এ দুটো প্রশ্ন একই নয়, অথচ এক বানানে দুই প্রয়োজন সারতে গেলে বানানের খরচ বাঁচিয়ে প্রয়োজনের বিঘ্ন ঘটানো হবে।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৯০)
একই যুক্তি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “আমার বক্তব্য এই যে, অব্যয় শব্দ ‘কি’এবং সর্বনাম শব্দ ‘কী’এই দুইটি শব্দের সার্থকতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের ভিন্ন বানান না থাকলে অনেক স্থলেই অর্থ বুঝতে বাধা ঘটে। এমন-কি, প্রসঙ্গ বিচার করেও বাধা দূর হয় না। ‘তুমি কি জানো সে আমার কত প্রিয়’আর ‘তুমি কী জানো সে আমার কত প্রিয়’, এই দুই বাক্যের একটাতে জানা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হচ্ছে আর একটাতে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে জানার প্রকৃতি বা পরিণাম সম্বন্ধে, এখানে বানানের তফাত না থাকলে ভাবের তফাত নিশ্চিতরূপে আন্দাজ করা যায় না।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৮৪-৫)
সুতরাং বন্ধুগণ, আপনারা একা নন! বাংলা ভাষার বহু বিদ্বজ্জন এই ‘কি’ বনাম ‘কী’-এর যুদ্ধে ডাবলুডাবলুএফ-এর পরাক্রমী মাতঙ্গদিগের ন্যায় ধুলায় গড়াগড়ি দিয়েছেন।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: এপ্রিল ০৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,