” আমার আছে কথা দেওয়া মানে প্রতিশ্রুতির ।
ঘুমানো আগে বহু পথ চলার আছে বাকি। “
কবি রবার্ট ফ্রস্ট এই লাইন গুলি যেন ইন্দিরা গান্ধীর জন্য লিখে গিয়েছেন।
অনেকটা জীবন দর্শন হিসাবে ইন্দিরা গান্ধী মেনে চলতেন রবীন্দ্রনাথের এই বিখ্যাত গানের লাইনগুলি –
” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে॥
যদি সবাই ফিরে যায় , ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে॥ “
ভারত ভ্রমনের অংশ হিসাবে আমরা আক্টবরের ৩১ তারিখে ( ২০১২ ) দিল্লিতে। কখনো ভাবি নি যে একদিন ১ নং সফদার জং রোডের এই বাড়িটিতে আসতে পারব।
অনেকটা ভাগ্য ক্রমে আক্টবরের ৩১ তারিখ সকালের দিনটি কেমন ছিল !! কেমন ছিল দিল্লির আবহাওয়া !! তা আমাদের জানা হলো। হেমন্তের ঝলমলে আকাশ, সোনালী রোদ, বিরাট নীল আকাশ, খন্ড খন্ড সাদা মেঘ মেঘ আকাশে। ঠিক ২৯ বছর আগের এই দিনটিতে ঐ মূর্হুতে সারা ভারতের এক গ্রাম থেকে আর গ্রামের মানুষের মুখে এক উৎকন্ঠার ছাপ , দিল্লি তথা পুরা ভারত-বর্ষ থমথমে, সবার মুখে প্রার্থনা আর মাতা জী… মাতা জী… বলে মাতম। দিল্লির প্রচার মাধ্যমে কড়াকড়ি।
সবই তো স্বাভাবিক ছিল ১৯৮৪ এর ৩০ শে অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী উড়িষ্যা সফর করে বেশ রাতে ১ নং সফদার জং রোডের বাড়িটিতে ফিরে আসলেন, সোনিয়া গান্ধী জানালেন শিশুরা রাহুল ও প্রিয়াংকা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে এবং ওরা ভালোই আছে। বিশ্রামে যাওয়ার আগে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সেক্রেটারি আলেক্সজান্ডারের সাথে কথা বললেন তখন ইন্দিরা গান্ধীকে খুব ক্লান্ত ও দুঃশ্চিতাগ্রস্থ লাগছিল। তিনি স্বীকার করলেন যে তিনি খুব ক্লান্ত, ঐ সময়ই তিনি আর. কে ধাওয়ানকে ৩১ শে অক্টোবর গুরুত্ব পূর্ণ ছাড়া অন্যান্য কর্ম সূচি বাতিল করার জন্য বললেন।
মাঝ রাত অতিক্রান্ত হলে ইন্দিরা গান্ধী ঘুমাতে গেলেন, ঐ রাতে সম্ভবত তিনি খুব কমই ঘুমিয়েছিলেন। পাশের রুমে সোনিয়া গান্ধী রাত চারটায় জেগে উঠলেন তাঁর আ্যজমা মেডিকেশনের জন্যে ইন্দিরা গান্ধীও জেগে উঠলেন, সোনিয়া গান্ধীর রুমে গেলেন সোনিয়া গান্ধীকে সাহায্য করলেন ট্যাবলেট খুঁজতে সাহায্য করতে আর জানতে চাইলেন যে, সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ বোধ করছেন কিনা !! ঐ সময়টিতে পুত্র রাজীব গান্ধী কোলকাতা থেকে প্রায় এক শত কিলোমিটার দূরে এক রাজনৈতিক সফরে।
ঝকঝকে সকাল ঘড়িতে তখন সকাল দশটা বেজে দশ মিনিট, বাস ভবনের মাঠের রাস্তা ধরে ইন্দিরা গান্ধী হেঁটে চলেন বাস ভবনের পাশে আকবর রোডে নিজ দপ্তরে যাবেন, ইন্দিরা গান্ধী দেখলেন তাঁর নিজের দেহ রক্ষি বিয়ান্ত সিং উইকেট গেটে দাঁগিয়ে আছে, বিয়ান্ত সিং একজন পান্জাবী শিখ, তিনি ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি গার্ডের অন্যতম। একজন দেহ রক্ষি রোদের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্যে ইন্দিরা গান্ধী মাথার উপরে একটি ছাতা ধরে রাখলেন, একটু পিছনের আর. কে ধাওয়ান, ব্যক্তিগত রক্ষণাবেক্ষনের কাজে নিয়জিত থাকেন সেই নথুরামও আর. কে ধাওয়ানের সাথে সাথে হাঁটছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছোট একটি দল খুব কাছাকাছি।
আর. কে ধাওয়ানের সাথে পিছন ফিরে কথা বলেতে বলতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিবাদনের উত্তর দেওয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধী তাঁর হাত দুই খানা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি কর জোড় করে প্রার্থনা করার মত করে নমন্তে নমন্তে বলতে বলতে অভিনন্দন জানালেন। এর উত্তরে দেহ রক্ষী বিয়ান্ত সিং তার পিস্তল বের করে সরাসরি ইন্দিরার দিকে তাক করে ট্রিগারে টান দিলেন। এক সেকেন্ডে পৃথিবীটা উলট পালট হয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো, ইন্দিরা গান্ধী বললেন কী করছো তোমরা !! ঠিক সেই মুহূর্তে বিয়ান্ত সিং গুলি ছুড়ে দিলেন একটি গুলি ইন্দিরা গান্ধীর তলপেট আঘাত করলো।
আরো চারটা গুলি ছুড়লো বুলেটগুলি ঘাড়ে, বুকে, কোমড়ে আঘাত করলো, বিয়ান্ত সিং এর নির্দেশে পাশে থাকা আর এক জন শিখ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে পঁচিশটা বুলেটে ইন্দিরা গান্ধীর দেহ ঝাঁঝড়া হয়ে মাটিতে পড়ে রইলো লাল গোলাপের পাপড়ীতে ঢাকা জায়গাটিতে। মাম্মী মাম্মী বলে চিৎকার করতে করতে সোনিয়া গান্ধী ছুটে আসলেন।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সাইয়েন্সের ডাক্তারা পাঁচ ঘন্টা প্রানপন চেষ্টা করে চললেন একটি অলৌলিক ঘটনা ঘটানো জন্য। অবশেষে দুপুর দুই টা বেজে তেইশ মিনিটে ভারতের আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো কেঁদে উঠলো সারা ভারত বর্ষ।
– ক্যাথরিন ফ্রাঙ্কের ” ইন্দিরা” অবলম্বনে।
বুলেটের গুলিতে ইন্দ্রিরা গান্ধীর পড়নের শাড়ি ও পোশাক।
আমাদের ভ্রমণের বছরে ৩১ শে অক্টোবর ২৯ তম মৃত্যু দিবসে বাড়িতে একটি সাদা মাটা একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল।
তারিখ: অক্টোবর ৩১, ২০১২
রেটিং করুনঃ ,