লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ।
নিউইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রথম সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কবি জয়েস কিলমার। তাঁর নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালের ১০ অক্টোবর। আর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি নেন নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ সংবাদদাতা হারভাড ম্যাথুস (১৯০০-১৯৭৭)। তিনি ১৯৫৭ সালে ফিদেল কাস্ত্রো বেঁচে আছেন—এই খবরসহ একটি সাক্ষাৎকার ছেপে বিখ্যাত হন। তিনি ১৯২৯ সালের ১০ মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেটি নিউইয়র্ক টাইমসে ১৯২৯ সালের ২ জুন প্রকাশিত হয়।
হারভাড ম্যাথুস সাক্ষাৎকারে লেখেন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতকে ভবিষ্যৎ শক্তি হিসেবে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তাইয়ো মারু’ জাহাজে প্রশান্ত মহাসাগর ভ্রমণের সময় একদল আমেরিকান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। জাহাজটি আজই যোকোহামায় পৌঁছেছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের ভারতের চিত্রটি দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার। প্রশাসন একটি উদ্দীপ্ত জাতিকে ঐতিহ্য এবং জীবনের পুরো কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং তারা সেখানকার লোকদের বুঝতে পারছে না।
ভারতের স্বাধীনতা করা এক প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, তাঁর মতে ভারতের স্বাধীনতা নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ওপর, তাই এখন এই সম্পর্কে বিবেচনা করা অনর্থক। বিদেশি শাসন থেকে স্বাধীনতার চিন্তা করার আগে ভারতকে অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হবে। তবুও, তিনি মনে করেন, ভারত একদিন তার সমস্যা কাটিয়ে উঠে একটি মহান জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ভবিষ্যতের বিশ্বে এর যথাযথ স্থান নিয়ে নেবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, তিনি মনে করেন, ব্রিটিশরা অন্য কোনো বিদেশি জাতির চেয়ে আরও ভালো আইন তৈরি করে এবং সেগুলো সর্বদা স্বতন্ত্রভাবে ন্যায্য, সহনশীল এবং সার্থক। তবে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ প্রশাসনের মেশিনের মতো কাজে হতাশ, যা ভারতীয় মানুষের সঙ্গে মানবিক যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের হৃদয়হীন, নির্দয় ও অপমানকর আচরণ মানুষের দুর্দশার কারণ হয়েছে। তাদের বিধি আইনশৃঙ্খলা এনেছে কিন্তু গ্রামগুলোর কেন্দ্রে থাকা মানুষের জীবনব্যবস্থাকে কেড়ে নিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ভারতের দারিদ্র্যের মূল কারণ গ্রামে যে প্রাচীন সম্পদগুলো ছিল তার স্থানচ্যুতি। মানুষ তাদের কেন্দ্রের ভারসাম্য হারিয়েছে। গ্রামের দুর্দশা অবিশ্বাস্য। জনগণ তাদের জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়েছে, তারা দুর্ভিক্ষ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ যেকোনো কিছুতে সহজেই আক্রান্ত হয়। ব্রিটিশরা নিষ্ক্রিয়ভাবে তাদের মরতে দেয়। এখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন পুরো ভারতীয় জীবনের কাঠামোকে স্থানচ্যুত করেছে। প্রথমে এটি এতটা স্পষ্ট ছিল না, তবে প্রতিদিন ক্ষয়ের চিহ্ন আরও প্রকট হয়ে উঠছে এবং অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়ছে। দেরিতে হলেও সরকার আমি যা বলেছি তার সত্যতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। রাজকীয় কৃষি কমিশনের মতো সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।’
রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, ‘জনগণের শিক্ষার জন্য কার্যত ব্রিটিশরা কিছুই করেনি। তারা প্রশাসনের জন্য যথেষ্ট খরচ করলেও মানুষের শিক্ষা, পয়ঃপ্রণালি ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য খুব সামান্য অর্থই ব্যয় করেছে। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কাজে আসেনি।’
কলকাতা থেকে ১০০ মাইল দূরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী আংশিকভাবে স্ব-সমর্থিত এবং আংশিকভাবে তার ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গান্ধীর আন্দোলনে জনসাধারণের মধ্যে কোনো আগ্রহ আছে কিনা—এই প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে মানুষ খুব বেশি উদাসীন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বা সভ্যতার প্রতি তাদের কোনো বিরোধ বা বিরোধিতা নেই। গান্ধীর আন্দোলন জনতার কাছে যে আবেদন করেছে, তা চরিত্রগত ভাবে সাংস্কৃতিক নয়। এটা অনেকটা ব্যক্তিগত। তাঁর প্রতি তাদের এমন একটা মানসিক মনোভাব তৈরি হয়েছে, যা আস্থা এবং যুক্তির ভিত্তিতে নয়। তাঁর আন্দোলন শিক্ষিত শ্রেণিকে ঘিরে পরিচালিত, যা তাদের দেশপ্রেমকে আরও তীব্র করে তোলে।’
গান্ধীর প্রতি তাঁর নিজস্ব মনোভাব হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, গান্ধীর আন্তরিকতা, দেশপ্রেম এবং উচ্চতর আদর্শের জন্য প্রশংসাযোগ্য। তবে তাঁর তত্ত্বগুলোর ব্যবহারিক মূল্য হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে সন্দেহযুক্ত।
বলশেভিকদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বলশেভিকরা ভারতে প্রবেশ করেছে। তবে বাংলা প্রদেশে তারা প্রবেশ করেছে তেমনটি তিনি জানেন না।
‘আমি দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি দেশ যখনই কিছু অপছন্দ করে, তখনই সেটাকে বলশেভিক হিসেবে চিহ্নিত করে—একটি চল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের সময় এবং এর পরে সবকিছু যা আপনি পছন্দ করেন না, সবই প্রো-জার্মান হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সুতরাং বলশেভিক মতামত হলো সর্বশেষ রোদন। তবে এটি বাংলায় আছে বলে আমি জানি না, অথবা হয়তো বা গোপনে আছে, মানুষ যারা এটা নিয়ে কথা বলে তারা হয়তো কিছু নিদর্শন পেয়েছে। আমাদের ভারতে এত দুর্দশা ও দারিদ্র্য রয়েছে যা ধ্বংসাত্মক প্রচারের জন্য দরজা উন্মুক্ত রেখেছে। ভারতে অনেক মানুষই এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা মনে করে, যেকোনো মূল্যেই যেকোনো পরিবর্তনই কাম্য। আমি জানি, ভারতে কিছু মানুষ সোভিয়েত থেকে অর্থ নিয়েছে। অথচ এদের জন্য কোনো কিছুই করেনি।’
আমেরিকান লেখক ক্যাথরিন মায়ো একজন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী, গবেষক, ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক লেখক। ভারত নিয়ে তার বিতর্কিত বই ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯২৭) এর জন্য তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। যেখানে তিনি হিন্দু সমাজ, ধর্ম এবং ভারতের সংস্কৃতিকে আক্রমণ করেছিলেন। মায়োর সমালোচকেরা তাঁর কাজকে বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
‘মাদার ইন্ডিয়া’ সম্পর্কে অনিবার্য প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, যখন এটা ভারতকে আঘাত করে, নিঃসন্দেহে তা আমেরিকারও ক্ষতি করে। তিনি বলেন, ‘বইটি যে লেখা হয়েছে তাতে আমি অবাক হই না। বরং অবাক হই যখন দেখি সেই দেশে হাজার হাজার মানুষ এই বই পড়েছে। আমি বিশ্বাস করতে পারি না, এত মানুষ সত্যি সত্যি ভারতকে নিয়ে আগ্রহী।’
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর সমস্ত বিবৃতি গিলেছে, বিশ্বাস করেছে এবং সেগুলো উপভোগ করেছে। ভারতর যখন প্রয়োজন তখন তা কখনোই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু যখন আপনাদের সামনে বিরক্তিকর এবং নিষ্ঠুর যৌন বিকৃতির একটি গল্প পাতা হলো, আপনারা তা অসাধারণ আনন্দে লুফে নিলেন। আমি এই পাঠকদের জন্য দুঃখিত এবং লেখকের জন্যও, যিনি এমন কিছু তৈরি করেছেন যা পাঠকের মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাসের জন্য ভুল। বইটি বিচ্ছিন্ন এবং টুকরো টুকরো ঘটনার সমষ্টি। বইটিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ভুল বিবৃতি যা বইটির পরবর্তী সংস্করণেও সংশোধন করা হয়নি। আপনি কি মনে করেন যে আমি আমেরিকা সম্পর্কে ক্ষতিকারক বা তার চেয়েও বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারি না? আপনি কি নিজে মনে করেন না, নর্দমার কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে এমন একটি বইয়ের জন্য যথেষ্ট উপাত্ত পাওয়া যাবে? আপনারা আমেরিকানরা সত্যি অন্ধ বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে আপনাদের নিজেদের মধ্যে বর্ণ প্রথা আছে, যা আমাদের মতোই বেশ কঠোর। যেমন নিগ্রোদের প্রতি আপনাদের ব্যবহার, তবে আপনারা তা উপেক্ষা করে আমাদের দিকে লজ্জার আঙুল তুলে দেখান। ভারতে বর্ণপ্রথার গভীর নৈতিকতা এবং ঐতিহাসিক পটভূমি না বুঝে আপনারা সমালোচনা করেন। পরিশেষে আমি বলতে চাই, কয়েক শতাব্দী ধরে বারবার নিগ্রহ কাটিয়ে ওঠা ভারতীয় মানুষের মনে এখনো কিছু ইতিবাচক উপাদান আছে। আমি নিশ্চিত, আমাদের মানুষের জয় হবে এবং চূড়ান্তভাবে বিশ্বের কাছে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেবে।’
সূত্র : প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,