লেখক: অরুন্ধতী রায় পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় লেখক
ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ কিছুটা দুর্বল হয়ে এসেছে। সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, এরই মধ্যে ভারতে চার লাখ মানুষ মারা গেছেন। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা বলছে, আসল অঙ্কটা ১০ গুণ। অর্থাৎ ৪০ লাখ মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছেন শুধু করোনায়। গণচিতায় যখন সারি সারি লাশ দাহ করতে দেখা গেছে, নদীতে যখন সারি সারি লাশ ভাসতে দেখা গেছে, চিতা জ্বালানোর সামর্থ্য না থাকায় যখন অসংখ্য লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলতে দেখা গেছে, ঠিক তখনই ভারতের রাজপথের পাশে ‘থ্যাংক ইউ মোদিজি’ লেখা বিরাট বিরাট বিলবোর্ড আর হোর্ডিং দেখেছি। করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার জন্য মোদিজিকে এই ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। অভিব্যক্তিটি এমন, যেন মোদিজি সবার জন্য ‘ফ্রি ভ্যাকসিন’ নিশ্চিত করেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো ভারতের ৯৫ শতাংশ মানুষ এখনো টিকা নিতে পারেননি।
কিন্তু যে বা যারাই এই বাস্তব ছবি তুলে ধরেছে, যে বা যারাই উন্মুক্ত স্থানে দাহ করার বা নদীতে লাশ ভেসে বেড়ানোর ছবি ও খবর প্রকাশ করেছে, তাকেই মোদি সরকার বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। সম্প্রতি ফরবিডেন স্টোরিজ নামের একটি অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে বৈশ্বিক নজরদারি ও সাইবার গুপ্তচরবৃত্তিবিষয়ক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে সহায়তা করার জন্য অন্তত ১৭টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মোদি সরকার এবং তাদের সহযোগী সংবাদমাধ্যমগুলো একই অভিযোগ এনেছে।
অ্যামনেস্টি এবং ফোরবিডেন স্টোরিজের প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের নজরদারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের কাছ থেকে পেগাসাস স্পাইওয়ার নামের ফোনে আড়ি পাতা প্রযুক্তি যেসব দেশ কিনেছে, তাদের মধ্যে ভারতের নামও আছে। এনএসও এই প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করেনি। তারা বলেছে, যেসব দেশের মানবাধিকার রেকর্ড ভালো এবং যেসব দেশে বৈধ সরকার আছে, শুধু সেসব দেশের সরকারগুলোর কাছে তারা সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ওপর নজরদারিতে সহায়তা করতে এই প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। এনএসওর বিবেচনায় মানবাধিকারের দিক থেকে উতরে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকোও আছে। এখন কথা হলো, কে অপরাধী আর কে সন্ত্রাসী, তার সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করবে? সেই সংজ্ঞা কি এনএসও এবং তাদের খদ্দেররা ঠিক করবে?
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ফোনে আড়ি পাতার এই স্পাইওয়ারের দাম সাধারণ মানুষের কল্পনারও অতীত। একেকটি ফোনে আড়ি পাতা বাবদ এনএসও-কে কয়েক লাখ ডলার দিতে হয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, পুরো সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোম্পানিটিকে প্রকল্পের মোট খরচের ১৭ শতাংশ অর্থ ফি বছর দিতে হবে বলে চুক্তি হয়েছে। একটি দেশের সরকার তার দেশের বেসামরিক লোকদের ওপর গোয়েন্দাবৃত্তি করার জন্য বাইরের দেশের একটি কোম্পানির সহায়তা নিচ্ছে এবং এসব তথ্য সেই বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকছে—এটি সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা লঙ্ঘন।
একটি তদন্ত দল ফাঁস হওয়া তালিকাভুক্ত ৫০ হাজার ফোন নম্বর এবং সেগুলোর মালিকদের তথ্য পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একজন খদ্দের এনএসওর কাছে ভারতের এক হাজার ফোনের তথ্য চেয়েছে। এসব ফোনের সব কটি এনএসও সফলভাবে হ্যাক করতে পেরেছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ফোনগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হবে। ভারতে তালিকাভুক্ত ফোনগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি পরীক্ষা করে ইতিমধ্যেই সেগুলোতে পেগাসাস স্পাইওয়ারের ‘সংক্রমণ’ পাওয়া গেছে।
ফাঁস হওয়া তালিকায় বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিক, ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের একজন নন-কমপ্ল্যায়ান্স কর্মকর্তা, কেবিনেট মন্ত্রীরা ও তাদের পরিবার–পরিজন, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিদেশি কূটনীতিক, এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ফোন নম্বরও রয়েছে।
ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা এই তালিকাকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ভারতীয় রাজনীতিকে ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা জানেন, তাঁরা ভালো করেই বুঝতে পারছেন, অতি সুদক্ষ ও তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানসম্পন্ন কোনো কল্পকাহিনি লেখকের পক্ষেও এ ধরনের তালিকা তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, একটা ফোনের গল্পের সঙ্গে আরেকটা ফোনের গল্প এমনভাবে জড়িয়ে আছে এবং ডিজিটাল দিক থেকে এগুলো এতটাই নির্ভুল যে, তা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব।
আমাদের যেমনটা বলা হয়েছে, যে ফোনে পেগাসাস বসানোর জন্য টার্গেট করা হয়, সে ফোনে শুধু একটা মিসড কল দেওয়া হয়। চিন্তা করে দেখুন। একটা মিসড কলের মধ্য দিয়ে একেকটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে। এর একেকটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে একেকটি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে, গোটা সমাজে অস্থিরতা ছড়াতে পারে, কোনো রকম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই কত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
ভারতের সঙ্গে এনএসওর যোগসূত্রের শুরু ২০১৭ সালে। ওই বছর মোদি ইসরায়েল সফর করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তিনি সৈকতে ট্রাউজার পরে হাঁটাহাঁটি করেছিলেন। বিশ্লেষকদের তথ্য বলছে, ওই সময় ভারতের পক্ষ থেকে এনএসওকে ফোন নম্বরগুলো দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক ওই বছর ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল তাদের ব্যয় বরাদ্দ ১০ গুণ করেছিল। বর্ধিত তহবিলের বেশির ভাগই সাইবার সিকিউরিটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার মোদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর আনলফুল অ্যাকটিভিটিস (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট নামের কালাকানুন (যার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে বিনা জামিনে বছরের পর বছর জেলে পচানো হয়েছে) সম্প্রসারিত করা হয়েছে। সংশোধিত ওই আইনে শুধু সংগঠন নয়, ব্যক্তিকেও ধরা যাবে। সংগঠনের নামে যেহেতু স্মার্টফোন নেই, স্মার্টফোন যেহেতু ব্যক্তির হাতে থাকে, সেহেতু ব্যক্তির দিকেই সরকারের মনোযোগ বাড়ানো হয়।
ভারতে ভিমা কোরেগাঁও সহিংসতার মামলায় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১৬ জনকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়; যাঁদের মধ্যে অধিকারকর্মী, আইনজীবী, শ্রমিকনেতা, অধ্যাপক ও দলিত নেতারা আছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, ওই ১৬ জনের মধ্যে আটজনের ফোনে পেগাসাস বসানোর জন্য ইসরায়েলি কোম্পানিকে বলা হয়েছিল। এই ধরনের লোকেরাও এনএসওর বিবেচনায় ‘সন্ত্রাসী’ এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এইভাবে শুধু ওই লোকদের নয়, তাদের পরিবার–পরিজন এবং তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখা বহু লোক সরকারের আড়ি পাতার জালে আটকে গেছে।
এই ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে একটি স্মার্টফোন একজন ব্যক্তির একান্ত গোপনীয় একেকটি সিন্দুক। সেখানে যারা ঢুকে পড়ে, তারা দুর্বৃত্ত। তাদের ঠেকাতে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
লেখক: অরুন্ধতী রায় পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় লেখক
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ২৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,