ভারতের লোকসভা নির্বাচনে পঞ্চম দফায় ভোটারেরা কত বেশি বুথমুখো হন, তা দেখতে ক্ষমতাসীন বিজেপি উন্মুখ থাকলেও সোমবার আমজনতার নজর ঘোরাফেরা করেছে প্রধানত আমেথি ও রায়বেরিলি আসনে। একদা ‘কংগ্রেসি দ্বীপ’ বলে পরিচিত এই দুই আসন এবার নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দেবে, উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে গান্ধী পরিবারের অবস্থান আগামী দিনে কেমন হবে।
একই রকম বোঝা যাবে যে দলকে চাঙা করে তলানিতে ঠেকা মনোবল তুঙ্গে তুলে প্রিয়াঙ্কা তাঁর বাপ–দাদার খাসতালুক আমেথিতে আবার দলের ঝান্ডা ওড়াতে পারেন কি না। ধরে রাখতে পারেন কি না রায়বেরিলি জয়ের ধারাবাহিকতা। তিনি সফল হলে উত্তর প্রদেশের রাজনীতি আগামী দিনে নতুন ক্যানভাসে চিত্রিত হতে পারে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যদিও আগাম জয়ের বার্তা দিয়ে সোমবার বলেন, সারা দেশেই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে।
প্রথম তিন দফার ভোটের হার ছিল কম। সেটা চিন্তায় রেখেছিল শাসক বিজেপিকে। ভোটের হার ঘোরাফেরা করেছে ৬৬ শতাংশের আশপাশে, আগেরবারের তুলনায় যা প্রায় ৪ শতাংশ কম। পঞ্চম দফায় ভোটের হার বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নারী ও যুবাদের এগিয়ে আসতে বার্তা দেন সোমবার সকালে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোটের প্রাথমিক হার মোটেই আহামরি নয়। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে গড়ে ৫৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে লাদাখে। ৬৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। নির্বাচন কমিশন ইদানীং প্রথাবিরুদ্ধভাবে ভোটের চূড়ান্ত হার ঘোষণা করছে চার–পাঁচ দিন পর। সে নিয়ে বিরোধী মহলে প্রবল ক্ষোভ। সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে মামলাও চলছে। শুনানি ২৪ মে। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে এই পর্বের ৪৯ আসনের ভোট বিজেপিকে কতটা নিশ্চিত করবে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের কাছে এই পর্বও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। ছয় রাজ্য ও দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এই ৪৯ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি জিতেছিল ৩২টি, জোটসঙ্গী ধরলে সংখ্যাটা পৌঁছায় ৪১–এ। কংগ্রেসসহ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সংগ্রহ মাত্র ছয়। তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে এনডিএকে আগেরবারের ফল ধরে রাখতে হবে। কিন্তু তা হবে কি?
প্রথম তিন দফার ভোটের হার ছিল কম। সেটা চিন্তায় রেখেছিল শাসক বিজেপিকে। ভোটের হার ঘোরাফেরা করেছে ৬৬ শতাংশের আশপাশে, আগেরবারের তুলনায় যা প্রায় ৪ শতাংশ কম।
প্রশ্নটা জোরালো হয়েছে প্রধানত মহারাষ্ট্র, বিহার ও উত্তর প্রদেশের জন্য। মহারাষ্ট্রের ভোট এই দফায়ই শেষ। এই পর্বের মোট ১৩ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি ও তার জোট শিবসেনা বিরোধীদের একটিও জিততে দেয়নি। এবার কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? শিবসেনা ও এনসিপির ভাঙন কি বিজেপিকে নিশ্চিন্তে রাখতে পারবে? প্রশ্নগুলো উঠছে, কারণ, মহারাষ্ট্র থেকে বিজেপির পক্ষে আশাব্যঞ্জক খবর আসছে না। উদ্ধব ঠাকরে ও শারদ পাওয়ারের প্রতি সহানুভূতির হাওয়া থাকার খবর শেষ পর্যন্ত সত্য হলে বিজেপির পক্ষে চিন্তার। একই রকম চিন্তা বিহার নিয়েও। সেখানে ভোট হওয়া পাঁচ আসনে বিজেপি–জেডিইউ জোট গতবার বিরোধীদের দাঁত ফোটাতে দেয়নি। পাঁচটিই তারা জিতেছিল।
উত্তর প্রদেশে এ দফায় ভোট হলো ১৪ আসনে। এসব আসনের মধ্যে গতবার একটিমাত্র আসন জিতেছিল কংগ্রেস। রায়বেরিলি জিতেছিলেন সোনিয়া গান্ধী। এবার সবার নজর এই আসনের ওপর। এটা রাহুল গান্ধীর দ্বিতীয় নির্বাচনী আসন। পাশের আসন আমেথিতে গতবার রাহুল হেরেছিলেন স্মৃতি ইরানির কাছে। এবার আমেথিতে কংগ্রেসের প্রার্থী হন গান্ধী পরিবারের চল্লিশ বছরের নির্বাচনী এজেন্ট কিশোরীরাল শর্মা।
কিন্তু রায়বেরিলিতে রাহুলের সম্ভাব্য জয় নয়, রাজনীতিসচেতন মানুষের নজর বেশি আমেথির ওপর। কারণ, এই দুই আসন জিততে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। স্মৃতি ইরানিকে হারাতে পারলে প্রিয়াঙ্কার সাংগঠনিক ক্ষমতা যেমন স্বীকৃতি পাবে, তেমনই চনমনে হয়ে উঠবে রাজ্য রাজনীতি।
সোমবার উত্তর প্রদেশে ভোট হলো রাজধানী লখনৌ ছাড়া বুন্দেলখন্ড অঞ্চলেও। লখনৌয়ে বিজেপির প্রার্থী সাবেক সভাপতি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তাঁর জয় নিয়ে বিজেপি নিশ্চিত হলেও বুন্দেলখন্ডের আসনগুলো চিন্তায় রেখেছে। বিএসপি নেত্রী মায়াবতী এই ভোটে আশ্চর্যজনক নিষ্প্রভ হলেও যেটুকু প্রচার তিনি জোরের সঙ্গে করছেন তা এই বুন্দেলখন্ড এলাকায়। দলিত ও অনগ্রসর মানুষজন বরাবর তাঁকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ভোট বিএসপি টেনে নিলে তার কী প্রভাব বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের ওপর পড়বে সেই হিসেব চলছে নিরন্তর।
ভোট হলো ঝাড়খন্ডের ৩ ও ওডিশার ৫ আসনেও। ঝাড়খন্ডের তিনটি আসনই ছিল বিজেপির দখলে। এবার ওই রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের বন্দিদশা সহানুভূতির হাওয়া কতটা বওয়াবে তার ওপর নির্ভর করছে বিজেপির ভাগ্য। ওডিশার ৫ আসনের মধ্যে ৩টি ছিল বিজেপির দখলে। আসন বাড়াতে এবার এই রাজ্য বিজেপির পক্ষে সহায়ক হবে বলে ধারণা।
লাদাখেও সোমবার ভোট হলো, যেখানে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বৌদ্ধ সম্প্রদায় আন্দোলন চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। অনশন সত্যাগ্রহ করছেন পরিবেশ সচেতন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক। আবার এরই পাশাপাশি কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থনের প্রশ্নে মুসলমান অধ্যুসিত কারগিলের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সব পদাধিকারী একযোগে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা দাঁড় করিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। বিজেপি এই আসন হারালে গত দশ বছরের ধারাবাহিকতা যেমন নষ্ট হবে তেমনই নতুন করে আলোচিত হবে লাদাখের সীমান্ত পরিস্থিতি।
বিজেপিকে ‘চার শ পার’ করতে গেলে কিংবা নিদেনপক্ষে একার ক্ষমতায় ২৭২ পেতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে গতবারের ফল ধরে রাখতে হবে। তা পারবে কি না, এবারের ভোটের বড় আগ্রহ সেটাও। যে কয়টি রাজ্যে বিজেপি এবার আসন বাড়াতে ব্যগ্র, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া রয়েছে ওডিশা, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশ।
অন্ধ্র প্রদেশে বিজেপির সঙ্গী থাকলেও ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গে তারা দোসরহীন। যে সাত আসনে পশ্চিমবঙ্গে সোমবার ভোট হলো, সেগুলোর মধ্যে তিনটি আছে তাদের দখলে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) চালু করা ও সেই আইনে নাগরিকত্ব দান এই রাজ্যের উদ্বাস্ত মতুয়া মনকে কতটা আলোড়িত করতে পারল, তারও পরীক্ষা হলো সোমবার।
৫ দফার ভোটে ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪২৮টির (একটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপি জয়ী) ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। বাকি রইল ২ দফায় ১১৫ আসনের ভোট–ভাগ্য।
আগামী ২৫ মে ষষ্ঠ দফায় ভোট মোট ৫৮ আসনে। বিজেপির পক্ষে এই পর্বও গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সেদিন ভোট হবে দিল্লির ৭ ও হরিয়ানার ১০ আসনে; যেগুলোর সবকটি আগেরবার বিজেপি ও তার সঙ্গীরা দখল করেছিল। এই ৫৮ আসনের মধ্যে আগেরবার এনডিএ পেয়েছিল ৪৫টি। এই পর্বে রয়েছে উত্তর প্রদেশের ১৪ ও পশ্চিমবঙ্গের ৮ আসনের ভোট।
এরপর শেষ দফার ভোট ১ জুন। শেষ পর্বে রয়েছে হিমাচল প্রদেশের ৪, বিহারের ৮, উত্তর প্রদেশের ১৩, পশ্চিমবঙ্গের ৯ ও পাঞ্জাবের ১৩ আসন। এই দফার ভোটেও গতবার সিংহভাগ দখল করেছিল এনডিএ। চারশ পার করতে গেলে প্রতিটি পর্বই বিজেপির অগ্নিপরীক্ষা।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২০, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,